শিল্পচেতনা

সফিউদ্দীন আহমেদ যে-শিল্পদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন তাতে তার কাছে ছবি আকাটা কখনোই সহজ বিষয় বলে বিবেচিত হয় নি। জীবনের শুরু থেকেই তার কাছে মনে হয়েছে, ছবি আকাকে সহজভাবে নিলে শিল্পী হওয়া যায় না। ফলে শুধু ছবির জন্য ছবি কখনো তিনি আকেন নি।

ছবির ভেতরে কখনো কোনো ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন নি। ছবি আকার সঙ্গে আবিষ্কার করেছেন নিজ মনের বিপুল আনন্দের এক গভীর সম্পর্ক। তার মনে হয়েছে, ছবি এঁকে নিজে আনন্দ পেলে সেই আনন্দের ভাগ অন্যকেও দেওয়া যায়। যে ছবি একে তিনি নিজে আনন্দ পেয়েছেন, যে ছবি তার নিজের ভালো লেগেছে, দেখেছেন অন্যরাও সেই ছবিকে ভালো বলেছে।

সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পরুচি গঠনে তাঁর পিতৃ-মাতৃসূত্রে প্রাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ঝোঁক, সংগীতানুশীলন, সংগীতানুরাগ, জ্ঞানচর্চায় আগ্রহ, নিয়মনিষ্ঠা প্রভৃতির রয়েছে সুগভীর প্রভাব। এগুলোর পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাঁতারে আগ্রহ, শিকারে আগ্রহ, বিদেশি কুকুর পালনে আগ্রহ প্রভৃতিতে যেমন তার নাগরিক রুচির প্রকাশ ঘটেছে তেমনি তার চিত্রের মধ্যে পরিস্ফুটিত হয়েছে নাগরিক বৈদগ্ধ্য। এই নগরমনস্কতা এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলীর উন্নত শিল্পাদর্শ ও ব্যক্তিত্ব তার শিল্পভাবনায় এনেছে বিশুদ্ধতার প্রতি প্রবল ঝোঁক এবং তীকে ব্রতী করেছে শিল্পের সাধনায়। শিল্পের তৃষ্ণাই তার মধ্যে জন্ম দিয়েছে নিসর্গ অনুশীলনের আগ্রহ। এই পিপাসাই তাকে টেনে নিয়েছে ষ্টুডিওর বাইরে, এমনকি কলকাতারও বাইরে। নিসর্গ অনুশীলনের সূত্রেই তিনি অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির বিশালত্বকে; তার চিত্রে এসেছে বিরচন-কৌশলের (কম্পোজিশন) দক্ষতা; এসেছে উন্নত পরিপ্রেক্ষিতের (পারস্পেকটিভ) বোধ। দূমকায় গিয়ে তিনি যথার্থভাবে অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির স্বরূপসহ তার আত্মাকে। ফলে চিত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির বিশাল পরিপ্রেক্ষিতকে। ক্ষুদ্বায়তনে বিশালত্বের ব্যাঞ্জনা সৃষ্টির বিষয়টি পরিণত হয়েছে তার চিত্রধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

১৯৪৭-এ নিজ জন্মস্থান থেকে উন্মুলিত হয়ে ঢাকায় নতুন বসতি নির্মাণের পর তিনি নতুন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পূর্ববাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনকে দেখেন নতুন চোখ দিয়ে। দুই বাংলার প্রাকৃতিক স্বাতন্ত্র্য সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। ওখানকার প্রকৃতিতে ছিল ধূসরতা, এখানে এসে দেখেন নীলাভ সবুজের ছড়াছড়ি । নীল ও সবুজকে একত্র করতে গিয়ে প্রথমে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। পূর্ববাংলার প্রকৃতির রঙের এই বিশিষ্টতা অনুধাবন করতে তিনি সাইকেল চালিয়ে বহুদিন চলে গেছেন পাগলা এলাকায় । নীল ও সবুজকে মিশিয়ে আকাঙ্ক্ষিত এফেক্ট আনতে তাঁর লেগেছে বেশ কয়েক বছর। তার তেলচিত্রে নীল ও সবুজের সুক্ষ ও পরিমার্জিত ব্যবহার দেখলে এই সাধনার বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া তিনি পরিচিত হন এখানকার বন্যার সঙ্গে। সেই সঙ্গে জাল-মাছ ও নৌকার সঙ্গে। তিনি দেখেন লোকজীবনের বৈচিত্র্য । এ কালপর্বে তার ছবিতে পরিস্ফুটিত হয় লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য।

পঞ্চাশের দশকে লোকশিল্পকে অঙ্গীকার করে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এসময় লোকশিল্পের প্রভাবে নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এদেশের আধুনিক চিত্রকলা। সফিউদ্দীন আহমেদও এই নতুন ধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তবে তিনি লোকশিল্লের রং, রেখা কিংবা উপাদান দ্বারা সরাসরি নিজের শিল্পকে সমৃদ্ধ করার পথে অগ্রসর হন নি। তিনি লোকশিল্পের সামান্য কিছু বৈশিষ্ট্যসহ সরাসরি লোকজীবনকে আশ্রয় করে এ ধারার চিত্রে সৃষ্টি করেন নতুন ভাষ্য। লোকজ শিল্পের ধাচে আকা তার একগুচ্ছ রেখাচিত্র, যেমন : “গুণটানা’-১ ও ৩ (১৯৫০, ১৯৫১), “মাছধরা’-১ (১৯৫০), “দম্পতি’ (১৯৫০), “বেহালাবাদকসহ ছাদ-পেটানো’-১ (১৯৫০) প্রভৃতি এবং ‘কাঠমিস্ত্রি’ (তেলরং, ১৯৫৬) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ গতানুগতিক লোকশিল্পের নানা উপাদানকে অঙ্গীকার না-করে তিনি বাস্তবোচিতভাবে অন্থিত করেছেন লোকজীবনকে এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য। মাধ্যমগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্রতী হওয়ার বিষয়টিও তার শিল্পবৈশিষ্ট্যের অংশ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি দুটি মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন। এ দুটি হলো : রেখাচিত্র ও তেলচিত্র। অন্য মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি কিছুদিন অনুশীলনের পর সেটি ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন, নিয়মিত ছাত্রজীবনের পর তিনি আর জল রং মাধ্যমে ছবি আকেন নি। ছাত্রজীবনেই শুর করেছিলেন উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমের চর্চা, সেটি লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কলকাতায় শিক্ষকতা কোর্সে অধ্যয়নকালে ড্রাইপয়েন্ট মাধামে ছবি একেছেন, তারপর আর আকেন নি। ওই সময়েই কোর্সের প্রয়োজনে লিথোগ্রাফি ও ম্যুরাল পেইন্টিং মাধামের চর্চা করেছিলেন, কিন্তু পরে আর এ বিষয়ে আগ্রহ দেখান নি। ওই সময়েই তিনি আ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে চিত্র রচনা করেছেন। ঢাকায় এসেও এ মাধ্যমে ছবি একেছেন। এবং ১৯৫৬ সালে লন্ডন গিয়ে এচিং মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা লাভের পর এচিং, আ্যাকুয়াটিন্ট, সফটগ্রাউন্ড, লিফটগ্রাউন্ড, ডিপ এচ প্রভৃতি নানা মাধ্যমের মিশ্রণ ঘটিয়ে চিত্র রচনা করেছেন। লন্ডনে শিখেছেন আরেকটি নতুন মাধ্যম : কপার-এনগ্রেভিং (তাম্রতক্ষণ)। সুতরাং উড-এনগ্রেভিং পরিত্যাগ করে এরপর তিনি এই নতুন মাধ্যমেই তক্ষণশিল্প রচনা করেছেন। তার ছাপচিত্রের অনুশীলন শুরু হয়েছিল উড-এনগ্রেভিং দিয়ে, শেষ হয়েছে কপার- এনগ্রেভিংয়ের মাধ্যমে । তার এই শিল্পযাত্রায় লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো : কোনো কোনো মাধ্যমের চর্চায় তিনি একপর্যায়ে নিজে আগ্রহ বোধ করেন নি, কোনো কোনো মাধ্যমের চর্চায় একপর্যায়ে নিজেকে যোগ্য বিবেচনা করেন নি, কোনো কোনো মাধ্যমে যথেষ্ট উন্নতি সাধনের পর তার মনে হয়েছে এক্ষেত্রে তার আর কিছু দেওয়ার নেই, কোনো কোনো মাধ্যমে তিনি নিজেকে দীর্ঘকাল গভীরভাবে নিয়োজিত রেখে ওই মাধ্যমের সম্ভাবনাসমূহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে উৎকর্ষমন্ডিত করে তুলেছেন। লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় : কপার-এনগ্রেভিং মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে তিনি যখন উপলব্ধি করলেন যে এ মাধ্যমের আধুনিক স্রষ্টা হেটারের প্রভাব তার কাজেও পড়ছে (দ্রষ্টব্য : “গুণটানা’, ১৯৫৮) তখন তিনি দীর্ঘকাল নিজেকে বিরত রাখেন এ মাধ্যমের চর্চা থেকে । তিনি সচেতনভাবেই চান নি কারো প্রভাব তার চিত্রে। দুই দশকের ব্যবধানে এ মাধ্যম নিয়ে যখন নতুনভাবে কাজ শুরু করেন তখন সেসব চিত্র রূপে-গুণে একেবারে ভিন্ন মাত্রা ধারণ করে। স্মরণীয় এ-পর্বের চিত্রসমষ্টি : ‘কান্না’ (১৯৮০), একুশে স্মরণে’ (১৯৮৭), একাত্তরের স্মৃতি (১৯৮৮) ও একাত্তরের স্মরণে’ (২০০২)।

লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রধারায় অবয়বধর্মী বাস্তবতাই ছিল মুখ্য। অবয়বকে তিনি ইতোমধ্যে ভাঙলেও তা নিজ পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে বিনাশ করে নি। কিন্ত্ব লন্ডনে যাওয়ার পর অবয়বকে তিনি এতটাই ভাংচুর করেন যে তা তার পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলে। এভাবেই তিনি বিশ শতকের মধ্যলগ্নে বিশ্বশিল্পে সংঘটিত আধুনিক ধারাকে অঙ্গীকার করেন। ফলে তাঁর চিত্রের জমিনে এসে ভিড় করে নানা অপরিচিত রূপকল্প (ইমেজ) । প্রতীক ও রূপকের ব্যাপক ব্যবহারে তার চিত্র সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধারণ করে। সেইসঙ্গে তিনি ব্রতী হন টেকনিকের নানা পরীক্ষা – নিরীক্ষায়। সুক্ষ রেখার পাশাপাশি ছাপচিত্রে স্থুল ও মোটা রেখা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরীক্ষায় রত হন তিনি।

ছাপচিত্রের প্রতি মাধ্যমেই সফিউদ্দীন আহমেদের রেখার একটা প্রবল গতি আছে। রেখার এই গতিধর্মের সঙ্গে যুক্ত তার সূক্ষ্মতা এবং কখনো কখনো ঋজুতা। দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁর ছাপচিত্রে এই সূক্ষ্ম ও সরু রেখারই ছিল আধিপত্য । এই সূক্ষ্মরেখার স্থলে তিনি স্থুল বা মোটা রেখার অনুশীলন শুরু করেন ১৯৬২ সালে । ফলে ১৯৬২-পূর্ব ও ১৯৬২-পরব্তী তার ছাপচিত্র ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ১৯৬২- পূর্বকালে তার চিত্রে কিছু মোটা রেখার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাবে যেগুলো আসলে রেখা নয়, আ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সৃষ্ট নানা পরিসর (স্পেস)। এসব পরিসরকে আকুয়াটিন্টের দানাদার বৈশিষ্ট্য সহযোগে কালো করে হয়েছে, যা অনেকটা স্থুল রেখার রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু ১৯৬২ সালে তিনি যে স্থুল রেখার অনুশীলন করেন সেটা সচেতনভাবে এচিং মাধ্যমে। অ্যাসিডে খাইয়ে প্লেটে গর্ত সৃষ্টি করে বের করা হয়েছে এই স্থুল রেখা। সফিউদ্দীন আহমেদের জন্য এটি ছিল একটি নতুন পরীক্ষা । তিনি একপ্রকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এচিং মাধ্যমে স্থুল রেখা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তার ছাপচিত্রের জমিনে নিয়ে আসেন নতুন বৈচিত্র্য । ওই বছর এচিং-আ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে আকা “মাছ ধরার সময়’-১ ও ২ শীর্ষক চিত্র দুটি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

লন্ডনের শিক্ষা তার চিত্রের বিষয় ও কলাকৌশলে যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটায় তাতে রূপক- প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ হয়ে ওঠে অনিবার্ধ। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও অব্যাহত থাকে এই ধারা । এ কালে চোখ তার ছবিতে বিশেষভাবে প্রতীকী ব্যঞ্জনার দ্যোতক হয়ে ওঠে। একথা ঠিক, ষাটের দশকে মাছের রূপাবয়ব ও নৌকার গলুই তার চিত্রে চোখের আদল পেয়েছে। বিক্ষুব্ধ মাছ’ (১৯৬৪) শীর্ষক চিত্রে মাছের চোখটি প্রকাশ করছে_তার বৃদ্ধাবস্থাজনিত প্রতিবাদ। এসবই হয়তো বিক্ষিপ্ত চিত্র। কিন্তু আশির দশকে তিনি সরাসরি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে আকেন “কান্না’, ‘একুশে স্মরণে’, ‘একাত্তরের স্মৃতি’ ও পরবর্তীকালে একাত্তরের স্মরণে’ তাম্রতক্ষণ মাধ্যমের একগুচ্ছ চিত্র, যা চোখের এক নতুন রূপ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেন ঢাকা শহরে অবস্থানকালে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর রক্তলোলুপ স্মৃতি বিরাজমান ছিল । চোখের নানা অভিব্যক্তি পরিক্ষুটিত করার মধ্য দিয়ে তিনি ওই পরিস্থিতিকেই যেন আভাসিত করেন এসব চিত্রে । এ-পর্বেই তেলচিত্রে নারীর বিষাদমাখা চোখ এঁকেও তিনি একাত্তরের নির্যাতন-নিপীড়নসহ ভয়ংকর দুঃখকাতর পরিস্থিতিকে প্রতীকায়িত করেন।

এচিং, আ্যকুয়াটিন্ট, মেটাল-এনগ্রেভিং মাধ্যমে তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেন সার্থক সব চিত্রকর্ম। তার এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবচেয়ে সার্থক দৃষ্টান্ত তার জলের নিনাদ’ (১৯৮৫) শীর্ষক শিল্পকর্মটি। এটি করার জন্য তিনি ছাপচিত্রের প্রায় সবগুলো মাধ্যমকে একসঙ্গে ব্যবহার করেন। এর আইডিয়াটা তিনি নেন অর্কেস্ট্রা থেকে । অর্কেস্ট্রায় একসঙ্গে শত লোক বাদ্যযন্ত্র বাজায়, কখনো তার সুর হয়ে যায় ভীষণ চড়া, আবার কখনো তা নামতে নামতে নেমে যায় একেবারে সূক্ষ্ম খাদে, আচ্ছন্ন হয়ে যায় বিষাদে । এই যে চড়া সুর থেকে খাদে নামিয়ে আনা, সবগুলো যন্ত্রকে একসঙ্গে বাজানো এবং তার মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের অসাধারণ দক্ষতা অর্কেস্ট্রায় আছে তা থেকেই তিনি পরিকল্পনা করেন ছাপচিত্রের সবগুলো মাধ্যমকে ব্যবহার করে একটি চিত্র সৃষ্টির। এভাবেই তিন বছরের সাধনার ফল হিসেবে সৃষ্টি হয় ‘জলের নিনাদ’ ছবিটি, যাতে এচিং, আ্যাকুয়াটিন্ট, সুগার আ্যাকুয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, লিফটগ্রাউন্ড, এনগ্রেভিং, ডিপ এচ, ড্রাইপয়েন্ট প্রভৃতি মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়।

ছাত্রাবস্থা থেকেই কালো রঙের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা সৃষ্টি হয় শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের মনে । কালো তার কাছে বিবেচিত হয় রঙের রাজা হিসেবে । এই রংকে আয়ত্ত করা রীতিমতো দুরূহ মনে হয় তার কাছে। ফলে কালো রঙের অনুশীলনের জন্য ত্রিশ-চল্লিশ দশকেই বহুবার রাতের বেলা গেছেন কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনে । উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমে চিত্র রচনার সময়ে তিনি এই রঙের সমৃদ্ধি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। লন্ডনে গিয়েও তিনি কালোর প্রতি তার এই আকর্ষণ ও কৌতৃহল থেকে দূরে যেতে পারেন নি। কালোকে আয়ত্ত করার ব্যাপারে সেখানকার শিক্ষকদের সহায়তা কামনা করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-আ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে । তারপরও কালোর এই অনুশীলনে তৃপ্ত হয় নি তার মন। নব্বইয়ের দশকে এসে তিন বছরেরও অধিককাল যাবৎ তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাপৃত হন একগুচ্ছ রেখাচিত্র রচনায়, যেসব চিত্রে কালো রঙের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিল্পীজীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেন কিছুটা পরিতৃপ্ত লাভ করেন। এসব চিত্রকে তিনি নাম দেন ‘ব্যাক সিরিজ’ বা “কালো চিত্রমালা’ । এসব চিত্রে কালো রং ব্যবহারে তার এক প্রকার সিদ্ধিকে আমরা দেখতে পাই। প্রশ্ন উঠতে পারে, কালোর প্রতি কেন তার এই পক্ষপাত? বা, কেন এরূপ শ্রমনিষ্ঠা? নিজ জীবনের সংগ্বামশীলতাসূত্রেই কি তার অচেতন মনে সৃষ্টি হয়েছে কালোর প্রতি এমন আগ্রহ? নাকি কেবল একটি রঙের প্রতি এ নিছক ভালোবাসা? শিল্পীর নিজেরও জানা নেই এর উত্তর। সফিউদ্দীন আহমেদ যেহেতু সবসময় কঠিনের সাধনায় ব্যাপৃত সেহেতু কালোকে আয়ত্ত করার মতো এমন দুরূহ কর্মে ব্রতী হওয়া যেন তার স্বভাবের সঙ্গেই মানানসই । তাছাড়া আধার আছে বলেই আলো এতো আদরনীয়। তাই আলোর আকাঙ্ক্ষায়ই কালোর এরূপ তপস্যা।

আলোর এই আকাঙ্ক্ষাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার বহু চিত্রে সূর্যের রূপকল্প ব্যবহারের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা চিত্রে ব্যবহৃত সূর্যের রূপকল্প শিল্পীর অচেতন মনের গভীরে লালিত সুন্দরের প্রত্যাশাটিকেই যেন বাঙময় করে তোলে । এর মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে শিল্পীর ইতিবাচক জীবনভাবনা, প্রগতিচেতনা ও মানুষের প্রতি আস্থার বিষয়টিও।

বিষয়-গৌরব কিংবা রূপক-প্রতীকের ব্যাঞ্জনা সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পকর্মকে গভীরভাবে তাৎপর্যময় করে তুললেও এসব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে তার নির্মাণকৌশল ও সৃষ্টিশৈলীর দক্ষতা । ছাপচিত্র কিংবা তেলচিত্র উভয় ক্ষেত্রে তার ব্যাপক নিবিষ্টতা ও দীর্ঘ অভিনিবেশ লক্ষ করা গেছে। ছাপচিত্রের একটি প্লেট তৈরিতে কিংবা একটি তেলচিত্র অঙ্কনে তিনি দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন । তার কর্মপদ্ধতি ছিল এরকম অনেকগুলো স্কেচ আগে করে তার মধ্য থেকে পছন্দের খসড়াটিকে বাছাই করে মূল কাজে হাত দেওয়া। তবে প্লেটে কিংবা ক্যানভাসে কাজ শুরু করে স্কেচের দিকে আর তাকাতেন না। ক্যানভাসে ছবি আকতে গিয়ে অন্য শিল্পীদের মতো তিনিও কিছু সুবিধা পেতেন। তা হলো সব শিল্পীর মতো ক্যানভাসের সঙ্গে এক ধরনের আদান-প্রদানের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যেত। ছবি আকার প্রক্রিয়ায় ক্যানভাস কখনো কখনো নতুন ‘কিছু আইডিয়া উপহার দিত । আবার শিল্পীও ক্যানভাসে নতুন কিছু চিন্তা যোগ করলে ক্যানভাস তা গ্রহণ করত । অর্থাৎ কাজ করতে গিয়ে ক্যানভাস ও শিল্পীর নিজের দিক থেকে এমন কিছু নতুন এফেক্ট সৃষ্টি হতো, যা একেবারেই অভাবনীয়।

মাধ্যমগত আন্তঃধর্মীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও তিনি সফলতা দেখিয়েছেন । অর্থাৎ এক মাধ্যমের বৈশিষ্ট্যকে অন্য মাধ্যমের চিত্রে প্রয়োগ করেছেন সাবলীল ও সার্থকভাবে ৷ যেমন, ছাপচিত্র ও তেলচিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রেখাচিত্রে।

এচিংয়ের সূক্ষ্ম-সরু রেখা, এনগ্রেভিংয়ের বঙ্কিম গতিশীল রেখা, ড্রাই পয়েন্টের কাব্যিক মাধুর্যময় রেখা যেমন রেখাচিত্রে অন্দিষ্ট হয়েছে তেমনি আ্যাকুয়াটিন্টের মিহি দানাদার বৈশিষ্ট্য, তেলচিত্রের নানা স্তরময় রঙের প্রলেপগত মসৃণতা প্রভৃতি সমৃদ্ধ করেছে তার রেখাচিত্রের জমিন। আবার ছাপচিত্রের বিচিত্রগামী রেখা যেমন তেলচিত্রের জমিনকে বৈচিত্র্যময় করেছে তেমনি আ্যাকুয়াটিন্টের মিহি-দানাদার বৈশিষ্ট্যও তেলচিত্রের তলকে করেছে আকর্ষণীয় । এনগ্রেভিংয়ের গুণাগুণও তিনি সঞ্চার করার চেষ্টা করেছেন তেলরং মাধ্যমে । অন্যদিকে তেলচিত্রের টেক্সচারসহ অন্যান্য গুণও কখনো কখনো অন্ধিষ্ট হয়েছে ছাপচিত্রে কিংবা রেখাচিত্রে।

তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মে শৈলীগত ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেও তা টেকনিক সর্বস্ব নয়, বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও সৃজনশীলতায় তা সমান সমৃদ্ধ । এ সম্পর্কে তিনি বলেন : আমার মধ্যে সবসময় যে অতৃপ্তিটা কাজ করে তা সুন্দরের জন্য। আবার একই সঙ্গে তা উন্নত একটা টেকনিকের জন্যও । টেকনিক্যাল সাইডটাকে নিখুঁত করার দিকেই আমার ঝোক। টেকনিককে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করাই আসল কথা ।” এ কথা ঠিক, কল্পনার ঐশ্বর্য ছাড়া একটি ছবি সার্থক হতে পারে না। তিনি মনে করেন, ছবি হবে সুন্দর এবং একই সঙ্গে শৈলীগতভাবে সমৃদ্ধ । তবে শুধু টেকনিকসৰ্বস্ব নয়। অনেক ছবি আছে কেবল টেকনিকসর্বস্ব, সফিউদ্দীন আহমেদের ছবি সেরকম নয়।

তাঁর চিত্রবৈশিষ্ট্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তাঁর সব ছবির ভেতরেই স্পষ্ট হোক কিংবা অস্পষ্ট হোক বিষয়বস্তুর উপস্থিতি লক্ষণ যোগ্য। তাঁর চিত্র পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে এই বিষয়গত উপাদানের বৈভব। বিষয়ের এই মহিমা সৃষ্টি হয়েছে দেশের উপাদান থেকে । এদিক থেকে তার ছবি বাস্তবধর্মী। বিষয়-আহরণে তিনি দেশের আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। জীবনের পারাবত, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকা প্রকৃতি ও সাওতাল-জীবন, তেমনি ঢাকা-পর্বে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি তার চিত্রের উপজীব্য হয়েছে নানা শ্রমজীবী মানুষ ঢাকা নগরীর শরবতবিক্রেতা, বাদামবিক্রেতা, ফলবিক্রেতা, কাপড়বিক্রেতা, ছাদ-পেটানো মজুরসহ পূর্ব বংলার কৃষক, জেলে, মাঝি, ছুতার, কুমোর, তেলি প্রমুখ । বাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যসহ দেশের শ্রমঘনিষ্ঠ জীবনই যে কেবল তাকে আলোড়িত করেছে তা নয়। এদেশের সংগ্রামশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারাকেও তিনি অবলোকন করেছেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে । এই গৌরবময় সংগ্রামের একদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ । বিভিন্ন মাধ্যমে রচিত তার চিত্রমালায় বায়ান্ন ও একাত্তরের স্মরণে সৃষ্টি হয়েছে নানা চোখের ফর্ম, তার অশ্রু ও বিষাদের আখ্যান।

এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় তার দেশাত্মববোধের বিষয়টি । তার চিত্রে তিনি সবসময়ই দেশের স্বরূপসহ একটি জাতির যন্ত্রণাকে তার আবেগসহ তুলে ধরতে চেয়েছেন। তার দুমকাবিষয়ক চিত্রমালা কিংবা বন্যা-জল-মাছ-জাল শীর্ষক চিত্রগুচ্ছে গভীর স্বদেশানুরাগসহ আপন মাটির টান অনুভব করা যায়। তবে এই দেশচেতনা তাকে স্লোগানমুখরিত করে না, জীবনের মর্মমূলে গভীর বোধের কাছে তা আবেদন সৃষ্টি করে। এর কারণ, বিষয়বৈভবের সঙ্গে সবসময়ই সমৃদ্ধ শৈলীর একটা অসামান্য সমন্বয় ঘটাতে তিনি চেয়েছেন। এই সমন্বয়চেতনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যভাবনারও সম্মিলন ঘটেছে । তিনি মনে করেন, “আমাদের এঁতিহ্য ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু পাশ্চাত্য অনেক উন্নতি লাভ করেছে টেকনিক্যাল দিকগুলোতে ।” সে-কারণে ওদের কলাকৌশলকে তিনি গভীরভাবে আয়ত্ত করেছেন। আবার বিষয়বস্তর ক্ষেত্রে দেশের ইতিহাস, এতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরেছেন ভীষণভাবে । এভাবে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ের ভালো দিকগুলোকে সমন্বিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বশিল্পের সমকালীন আধুনিকতার সকল নির্যাসকে আয়ন্ত করে নিজ শিল্পভুবনকে সার্থকতায় মন্ডিত করেছেন।

সফিউদ্দীন আহমেদের একটি কথা উদ্ধৃত করে আমরা উপসংহার টানতে চাই । তিনি বলেছেন : ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন কাজ করে যেতে পারি সেটাই আকাঙ্ক্ষা । আমি তো আর কিছু চাই নি। না বাড়ি না গাড়ি না অর্থ না খ্যাতি। এসবের লোভ আমি করি নি । আমি শুধু ছবি আকঁতে চেয়েছি। সবসময়ই নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি। নতুন কিছু, ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এটা যখন না দিতে পারব তখন শিল্পী হিসেবে আমার মৃত্যু হবে। তারপর বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ হয়না। এ এক যথার্থ শিল্পীর উক্তি। মহৎ শিল্পীর সংজ্ঞার্থ কি আমার জানা নেই। তবে শিল্পী শফিউদ্দিন আহমেদের জীবনবৈশিষ্ট ও শিল্পসৃষ্টির সম্পর্কে জানলে। তাঁর শিল্পকর্মের দিকে গভীর ভাবে তাকালে ওই শব্দ দুটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা যায়।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।