তেলচিত্র

সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্রের প্রায় সবগুলো মাধ্যমেই সার্থকতা দেখানোর ফলে স্বাভাবিকভাবে ছাপচিত্রী হিসেবেই অধিকমাত্রায় আলোচিত। কিন্তু এই পরিচয়টি তাঁর প্রতিভার আরেকটি উজ্জ্বল দিককে কিছুটা হলেও আড়াল করে রেখেছে। তা হল, তেলরং মাধ্যমেও তিনি যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন সেই দিকটি অনেক সময়ই আলোচকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখব, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি এ মাধ্যমের অনুশীলনে ধারাবাহিকভাবে নিয়োজিত থেকে ছাপচিত্রের মতো এক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে নিরীক্ষাপ্রবণ।

এ মাধ্যমে রঙের ঘন প্রলেপ দিয়ে কাজ করার দিকেই তাঁর ঝোঁক। তেলচিত্র অঙ্কনের জন্য তিনি হার্ড বোর্ড ও ক্যানভাস উভয়ই ব্যবহার করেছেন। ব্রাশ স্ট্রোকের মাধ্যমে যেমন তিনি এ ধরনের চিত্র এঁকেছেন তেমনি এঁকেছেন রঙের মসৃণ প্রলেপ দিয়েও। একই সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন স্প্যাচুলার সাহায্যে ইমú্যাস্টো পদ্ধতির (রঙের ঘন প্রলেপ)। ক্যানভাসের ওপর জোসো দিয়ে চিত্রতল প্রস্তুতের প্রক্রিয়া তিনি অনুসরণ করেন নি। বরং তেলরং দিয়েই চিত্রের ভূমি নির্মাণ করেছেন। তেলচিত্র অঙ্কনেও তিনি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন দীর্ঘ সময়। এ মাধ্যমের কাজে এই সুযোগটি স্বভাবতই থাকে। এভাবে তেলরঙের চিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর নিজের স্বভাবেরই সামঞ্জস্য তিনি যেন খুঁজে পেয়েছেন। উল্লেখ্য যে, এ মাধ্যমেই তিনি সম্পাদন করেছেন সর্বাধিক সংখ্যক চিত্র। তাঁর নিরীক্ষাধর্মিতা, সাধকসুলভ বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রেও তাঁকে ক্রমশ সার্থকতার চূড়া স্পর্শ করতে সহায়তা করেছে ।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি তেলরং মাধ্যমটির অনুশীলন করলেও ওই সময়ের কোনো নিদর্শন আমরা পাই না। আমরা তাঁর আদিপর্বের একগুচ্ছ তেলচিত্র পাই যা আঁকা হয়েছে ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে, যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে তিনি শিক্ষকতার কোর্স করছেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, এর সবগুলি চিত্র তিনি এঁকেছেন দুমকা ভ্রমণকালে, তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ আউটডোর স্টাডি হিসেবে। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে অবস্থান করে বিষয় হিসেবে প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলম্বন করে তিনি এগুলো এঁকেছেন, অনেকটা জলচিত্র বা স্কেচ করার মতো। সময় লেগেছে এক থেকে দেড়ঘন্টা। ফলে এগুলোকে তিনি অভিহিত করেছেন তেলরঙের স্কেচ বলে। সবগুলো এঁকেছেন হার্ডবোর্ডে, সবগুলোর আকারও ছোট : দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি প্রস্থে ৯ ইঞ্চি। এরূপ চিত্র অঙ্কনের একটি ইতিহাস আছে। তা হল, তাঁর শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লন্ডন থেকে একটি ছোট বাক্স এনেছিলেন। তার ভেতরে খাঁজ করা যাতে হার্ড বোর্ড রাখা যায়। বাক্সটি নিয়ে চলাফেরা করা যেমন সহজ তেমনি সুবিধাজনক স্থানে বসে ডালার ওপর বোর্ড রেখে ছবিও আঁকা যায়। বাক্সে ১২ ইঞ্চি ৯ ইঞ্চি আকারের হার্ড বোর্ড রাখা যেত। ওই শিক্ষকের পরামর্শে সফিউদ্দীন আহমেদ ওই রকম একটি বাক্স তৈরি করে নিয়েছিলেন এবং সেটি দুমকায় নিয়ে গিয়ে তেলরঙের এ ছবিগুলো এঁকেছিলেন। এর মধ্যে বিশটি চিত্র এখনো তাঁর কাছে রক্ষিত আছে, যদিও সবগুলো ভালো অবস্থায় নেই, কোনোটি আবার অসমাপ্ত।

ছোট আকারের বোর্ডে আঁকা হলেও এসব চিত্রে রয়েছে প্রকৃতির বিশালত্বের ব্যঞ্জনা। কাজ করা হয়েছে ছোট ব্রাশ দিয়ে। তারই মধ্যে রয়েছে ব্রাশের স্ট্রোক, আছে রঙের ঘন প্রলেপ। কাজের ধরনটিই এমন যে, রং লাগানো হয়েছে একবারে, পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হয়ে। বারবার রং লাগানোর সুযোগ নেই কিংবা সুযোগ নেই পরিশীলনের, পরিমার্জনের কিংবা ঘষামাজার। এভাবে সংক্ষিপ্ত প্রয়াসে চিত্রগুলো সৃষ্টি হলেও এর শৈল্পিক উৎকর্ষ বা সৌন্দর্য ব্যাহত হয় নি। কয়েকটি চিত্র স্বতন্ত্রভাবে আলোচনাযোগ্য।

১৯৪৪ সালে আঁকা চিত্রগুচ্ছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘সূর্যালোকে কুটির’, ‘দুমকার কর্মচঞ্চল জীবন’ ও ‘দুমকার পথ-১’। ‘ময়ূরাক্ষী’ শীর্ষক চিত্রটিতে আঁকা হয়েছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ক্ষীণতোয়া ময়ূরাক্ষীর রূপ। যে দৃশ্যটিকে এ চিত্রে ধারণ করা হয়েছে তার বিরচনগত কৌশলটি প্রশংসনীয়। ব্রাশের স্ট্রোকসমৃদ্ধ এ চিত্রে পশ্চাদ্ভূমির সামান্য অংশে রয়েছে নদীতীর, বাকি পুরো অংশ জুড়েই নদীর জলধারাসহ চরের দৃশ্য। ক্ষীণ জলস্রোতের কারণেই হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে গরুর পালসহ রাখাল। চিত্রের পুরোভূমি জুড়ে নদীর জল। চিত্রের মধ্যভূমি পার হয়ে এই ধারাটি বেঁকে গিয়ে মোটামুটি সোজাভাবে বহু দূর চলে গেছে। এতে নদীর দীর্ঘতার একটি অনুভূতি দর্শকমনে প্রশান্তি এনে দেয়।

‘সূর্যালোকে কুটির’ চিত্রটিতে আঁকা হয়েছে সাঁওতালদের গার্হস্থ্যজীবনের একটি অন্তরঙ্গ দৃশ্য। বসতবাটীতে সাঁওতাল নারী-পুরুষের কর্মকোলাহলের সঙ্গে তাদের পালিত মুরগির স্বচ্ছন্দ বিহার ওই জীবনের বাস্তবতাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। ঘর ও গাছের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যায়িত হয়েছে আকাশ। চিত্রতলের পশ্চাদ্ভূমিতে বোর্ডের কিছু কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই সব অংশের বাদামি রং গাছের পাতার অন্যান্য রঙের সঙ্গে মিশে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। স্কেচধর্মী তেলচিত্রের এই দুমকা সিরিজের মধ্যে ‘সূর্যালোকে কুটির’ নিঃসন্দেহে একটি সার্থক সৃষ্টি।

‘দুমকার কর্মচঞ্চল জীবন’ শীর্ষক চিত্রটিতে বিরচনগত দক্ষতার পাশাপাশি পরিপ্রেক্ষিতের বোধটিও চমৎকারভাবে পরিস্ফুটিত। চিত্রতলের পুরোভূমিতে দুটি বৃহৎ গাছের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় দূরে যেখানে মধ্যভূমিতে রয়েছে আরও দুটি গাছ এবং সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কর্মচাঞ্চল্য। আরও দূরে পাহাড় এবং তার পেছনে পশ্চাদ্ভূমিতে আকাশ। পুরোভূমির গাছ দুটি কাট অফ এজ পদ্ধতিতে বিন্যস্ত। এখানেই শিল্পীর পরিপ্রেক্ষিতের বোধটি স্পষ্ট। দৃষ্টি যতই দূরে যাচ্ছে গাছ, মানুষ ও পাহাড়ের আকার ততই ক্ষীয়মাণ। চিত্রতলের অর্ধেক অংশ জুড়েই এভাবে আকাশের বিস্তার। ফলে প্রকৃতির বিশালত্ব এর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে। গাছের কাণ্ড, ডালপালা ও পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশকে বের করে আনা হয়েছে। এই চিত্রেও শিল্পী বোর্ডের কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে কখনো মাঠ কখনো গাছের পাতার রঙের একটা সমন্বয় সৃষ্টি করেছেন।

‘দুমকার পথ-১’ শীর্ষক চিত্রটিতে পথকেই মুখ্য করে তোলা হয়েছে। পথের দুপাশে বৃহৎ বৃক্ষসারি। পথটিই প্রধান হয়ে ওঠায় ছবিতে আঁকা হয় নি পূর্ণাঙ্গ গাছের কোনো রূপ। কাট অফ এজ পদ্ধতিতে বৃক্ষের উপরিভাগ ও কোথাও পার্শ্বভাগ কর্তিত। ফলে আকাশও ঢেকে গেছে। দুপাশের বৃক্ষ-শাখা পথকে আচ্ছাদিত করলেও সূর্যের প্রভাবে পথ ও বৃক্ষতল আলোকিত। দূর দূরান্ত থেকে পথ বেয়ে মানুষের চলাচলের এ চিত্র থেকে ফুটে উঠেছে চলমানতার এক নিবিড় বোধ। চিত্রে মানুষের এই পায়ে-হাঁটার বাস্ত-বতাই ওই বোধকে আরো গভীর করে তুলেছে। দুমকার এই পাকা সড়কে গাড়ি দেখা যেত কালে-ভদ্রে। মূলত গরুর গাড়িই চলাচল করত। কিন্তু এ চিত্রে তাও অনুপস্থিত। আদিবাসী সাঁওতাল জীবনধারার সঙ্গেই যেন মানানসই এ পায়ে-চলার চিত্র।

১৯৪৫ সালে আঁকা দুমকা পর্বের চিত্রগুচ্ছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘দুমকার পথ-২’, ‘দুমকার পথ-৩’, ‘শালবন দুমকা’, ‘দুমকা-১’ ও ‘দুমকা-২’। এ চিত্রগুলোও আঁকা হয়েছে একই আকারের বোর্ডে এবং তাৎক্ষণিকভাবে স্কেচ করার পদ্ধতিতে। ‘দুমকার পথ-২’ শীর্ষক চিত্রের পুরোভূমিতে রয়েছে দুটি বৃহাদাকারের বৃক্ষ। তার মাঝ দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে পথের দৃশ্য। চিত্রে পথটি বাঁ দিক থেকে এসে বেঁকে গিয়ে ঢালুতে নেমে আবার বেঁকে চলে গেছে ডানদিকে। পথটি মেঠো হলেও উঁচু ও প্রশস্ত। এ চিত্রেও পথ বেয়ে মানুষের চলাচলের দৃশ্য অঙ্কিত হওয়ায় জীবনের কোলাহল সম্পর্কে শিল্পীর অনুরাগ বোঝা যায়। এ চিত্রেও শিল্পীর পরিপ্রেক্ষিতের বোধটি অসাধারণ। একই কাট অফ এজ পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এভাবে উপরের আকাশ ঢেকে গেলেও পাতার ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝেই তা বেরিয়ে পড়েছে। এ চিত্রেও অনুসৃত হয়েছে বোর্ডের অংশবিশেষ ছেড়ে দেওয়ার রীতি । এ চিত্রগুচ্ছের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল : সমগ্র চিত্র জুড়ে আলো-বাতাসের উপস্থিতি একে করে তুলেছে সজীব ও প্রাণবন্ত। প্রায় একই দৃশ্য অবলম্বনে শিল্পী অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে ১৯৪৫ সালেই এঁকেছেন ‘দুমকা’ নামের আরেকটি চিত্র।

‘দুমকার পথ-৩’-এ শালবৃক্ষরাজিই সমগ্র চিত্রতলকে যেন আচ্ছন্ন করে আছে। তারই মধ্য দিয়ে একটি মেঠোপথ কিছুদূর গিয়ে বেঁকে সমান্তরাল হয়ে বেরিয়ে গেছে। পথ ধরেই হাঁটছে প্রচুর মানুষ, চলছে গরুর গাড়ি। শুধু বন, রাস্তা ও মানুষ নিয়ে এ চিত্র। চিত্রটিতে আছে স্ট্রোকের ব্যবহার, আছে রঙের ঘন প্রলেপ। যেখানে রঙটা হালকা বাদামি সেখানে আসলে বোর্ড ছেড়ে দিয়েছেন শিল্পী, অর্থাৎ কোনো রঙই লাগানো হয় নি। অন্য চিত্রের মতো এখানেও অনুসৃত হয়েছে আঁকার এ কৌশল । তবে সময়ের অভাবও কখনো শিল্পীকে এ কৌশল গ্রহণে বাধ্য করেছে। এ চিত্রেও শিল্পী আশ্রয় নিয়েছেন কাট অফ এজ পদ্ধতির । ফলে সমগ্র চিত্রতল জুড়ে পত্ররাজিসহ বৃক্ষেরই প্রাধান্য; ফলে আকাশ গেছে ঢেকে। তবে মাঝে মাঝে পাতার ফাঁকে সাদা রং ব্যবহার করে শিল্পী আকাশ বের করে এনেছেন। ক্ষুদ্র চিত্রতলে দীর্ঘ শালসারি বৃহত্ত্বের ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছে।

‘শালবন দুমকা’ চিত্রটিতে শিল্পীর বিরচন-কৌশলটি ভিন্ন মাত্রার। এখানে নিসর্গকে দেখা হয়েছে আরো কাছে থেকে। অর্থাৎ ক্লোজ শটের মাধ্যমে। ফলে বৃক্ষের আয়তন যেমন বেড়েছে, তেমনি কমে গেছে এর সংখ্যা। আর দৃষ্টিসীমা উপর থেকে আরো নেমে যাওয়ায় বৃক্ষের পত্রপল্লবিত উপরের অংশ কাটা পড়ে কেবল কাণ্ডই হয়েছে দৃষ্টিগোচর। বৃক্ষের দীর্ঘতা এ চিত্রে অনেক বেশি প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এই দীর্ঘতার পরিপ্রেক্ষিতটিই এ চিত্রের মূল বিষয়। অন্যদিকে পত্রের স্বল্পতার কারণে আকাশ অনেক বেশি দৃশ্যমান। গাছগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার সচেতন পরিকল্পনার কারণেই আকাশকে এভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চিত্রতলে ভূমির তুলনায় আকাশের ভাগ বেশি। নিসর্গের এই পটভূমিতে বিন্যস্ত সাঁওতাল নর-নারীর প্রাত্যহিক জীবনোদ্যমের অন্তরঙ্গ দৃশ্য চিত্রটিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। এখানে আছে ধান ও খড় নিয়ে নারী-পুরুষের সম্মিলিত কর্মোদ্যমের চিত্র। তাদের পরিহিত বস্ত্রের ভিন্নতা থেকেও পরিস্ফুট হয়েছে ওই জীবনের বাস্তবতা। উল্লম্ব-আকৃতির এই চিত্রটিতে সব মিলে ফুটে উঠেছে প্রকৃতিজগতের বিশালত্বের এক সুগভীর ব্যঞ্জনা।

‘দুমকা-১’ শীর্ষক চিত্রটির বিরচন-কৌশলে লক্ষণীয় একপ্রকার সারল্য। পরিপ্রেক্ষিতের যে-চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছে এ চিত্রে তাও প্রশংসনীয়। চিত্রের পুরোভূমিতে দুটি পূর্ণবৃক্ষসহ বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর, মধ্যভূমিতে দূরবর্তী পাহাড় আর পশ্চাদ্ভূমিতে রয়েছে প্রসারিত আকাশ। চিত্রতলের অধিকাংশ স্থান জুড়েই আকাশের বিস্তার, যা প্রকৃতিলোকের বিশালত্বেরই দ্যোতক। বিরচনের এই সারল্যের মধ্যেই পরিস্ফুট হয়েছে একপ্রকার শূন্যতার সৌন্দর্য। প্রকৃতিলোকের ওই বিপুল শূন্যতার মধ্যেই উন্মুক্ত প্রান্তরে গরু-মহিষের পদচারণা এবং এসব জন্তুর পিঠে আসীন মাথলা-জাতীয় ছাতা মাথায় রাখালের উপস্থিতি জীবনের স্পন্দনকেই যেন অনুভবগ্রাহ্য করে তুলেছে। এ চিত্রে রয়েছে স্ট্রোকের ব্যবহার। বোর্ড ছেড়ে দিয়ে বাদামি রং বের করে আনার কৌশলটিও ব্যবহৃত হয়েছে এ চিত্রে।

‘দুমকা-২’ চিত্রটিতে শালবৃক্ষের আড়ালে কিছুটা ঢাকা পড়েছে একটি বড় জলাশয়। জলাশয়ের পাড় বেয়ে সাঁওতাল নর-নারীর পথ-পরিক্রমা। প্রাত্যহিকতার মধ্যেই যেন জীবনের এক চিরন্তন চলচ্ছবি। দূরে ঘন বন আকাশের বৃহদংশকেই ঢেকে ফেলেছে। আকাশের সামান্য কিছু অংশ গাছের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান। এ চিত্রের বিরচন-কৌশলে বৃক্ষ ও বনকেই মুখ্য করে তোলা হয়েছে। এই বনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িত সাঁওতাল জীবনকে শিল্পী দুমকা-সিরিজের প্রতিটি চিত্রেই অনবদ্য করে তুলেছেন। এই বন্যসৌন্দর্যের সঙ্গেই যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে আদিবাসী জীবনের সারল্য ও সৌন্দর্য।

তেলরং মাধ্যমে আঁকা এই দুমকা-সিরিজের পরে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শিল্পীর কলকাতা জীবনপর্বে আমরা পাই ‘দীলিপ দাশগুপ্তের প্রতিকৃতি’ (১৯৪৬) ও ‘লিলি ফুল’ নিয়ে একটি জড়জীবন-চিত্র (১৯৪৭)। এছাড়া ‘ময়ূরাক্ষী তীরে নারী’ শীর্ষক চিত্রটি ১৯৪৮ সালে আঁকা হলেও এর বিষয় যেহেতু দুমকা সেহেতু এ-পর্বেই আলোচিত হতে পারে।

সফিউদ্দীন আহমেদ প্রতিকৃতি তেমন একটা আঁকেন নি। আরেকটি প্রতিকৃতি-চিত্র পাওয়া যায় তাঁর ছাত্র হামিদুর রহমানকে নিয়ে। এছাড়া কমিশন-কাজ হিসেবে আরো একটি প্রতিকৃতি-চিত্র অঙ্কনের তথ্য জানা গেলেও তার বিশদ-বিবরণ ঢাকা পড়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে। দীলিপ দাশগুপ্ত ছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের (১৯১৪-৭৬) সতীর্থ। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতায় শিল্পী দীলিপ দাশগুপ্ত কিংবা শিল্পী অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিয়মিত আড্ডা বসত, তাতে সফিউদ্দীন আহমেদও শরিক হতেন। এমন এক আড্ডাতে ছোট ক্যানভাসের ওপর তাৎক্ষণিকভাবে আঁকা হয়েছে এই চিত্রটি। মুখাবয়বকে কেন্দ্র করে মূলত শিল্পীর ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে। স্ট্রোকসমৃদ্ধ এই প্রতিকৃতি-চিত্রে চমৎকারভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে শিল্পীর সরল অভিব্যক্তিটি।

‘লিলি ফুল’ শীর্ষক জড়জীবন-চিত্রটি আঁকা হয়েছে কলকাতার পার্ক সার্কাসে শিল্পীর নিজ বাড়িতে ব্যক্তিগত অনুশীলন হিসেবে। বাড়িতে ফোটা ফুল নিয়ে জগে সাজিয়ে এটি আঁকার সময় শিল্পী বাস্তবকে হুবহু অনুকরণ করেন নি। বিশেষত রং ব্যবহারে শিল্পী বাস্তবকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। রঙের বিন্যাসে লক্ষণীয় সমন্বয় সাধনের চেষ্টা। যেমন, ফুলের রং ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার অভিপ্রায়ে পটভূমিতে স্থাপিত ঘন নীল কাপড়ের সঙ্গে শিল্পী সামঞ্জস্য বিধান করেছেন। চিত্রটিতে উন্মুক্ত পরিসরেরও বেশ সৃজনশীল ব্যবস্থা শিল্পী করেছেন। যাতে চিত্রতলে আলো-বাতাসের গতি সহজতর হয়। যদিও এ চিত্রে ফুলগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, চিত্রতলে বাড়তি কোনো পরিসর নেই। তবু তারই মধ্যে এ চিত্রে ফরমাল স্পেস ও নেগেটিভ স্পেস নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি চমৎকার সুসামঞ্জস্য। চিত্রটিতে রয়েছে ঘন রঙের প্রলেপ। স্কুলের শ্রেণি-অনুশীলনের বিধিবদ্ধ চাপ থেকে মুক্ত থাকায় এ-চিত্রে স্বকীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছেন শিল্পী ।

‘ময়ূরাক্ষী তীরে দুই নারী’ চিত্রটিতে যে দৃশ্য আঁকা হয়েছে তা নিয়ে শিল্পীর আরেকটি চিত্র আছে ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে (১৯৪৫)। এই তেলচিত্রটি তিনি এঁকেছেন নিজ স্টুডিওতে বসে। প্রকৃত দৃশ্যপট থেকে শিল্পীর তখনকার অবস্থান অনেক দূরে। এমনকি কলকাতায়ও তিনি নেই। দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট নতুন দেশে নতুন পরিবেশে ঢাকায় তখন তাঁর নতুন জীবন। অন্যদিকে যখন তিনি ওই দৃশ্য দেখেছেন তা থেকে সময়ের ব্যবধানও অনেক Ñ তিন বছর। আউটডোর স্কেচ, ড্রাই-পয়েন্ট-চিত্র ও স্মৃতি অবলম্বনে তিনি এঁকেছেন এ চিত্রটি। এর বৈশিষ্ট্য হল, এখানে বহির্রেখা (কনট্যুর) ব্যবহার করেন নি শিল্পী। ভিন্ন ভিন্ন রঙের মাধ্যমে কিংবা রং মিলিয়ে দিয়ে পৃথক করা হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে এবং মানুষের শরীরের নানা অংশকে। এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, শিল্পী তাঁর তেলচিত্রে সাধারণত ঘন রঙের প্রলেপ দিতে অভ্যস্ত, কিন্তু এ চিত্রে দেওয়া হয়েছে পাতলা রঙের প্রলেপ। এ চিত্রের বিরচন-কৌশলটিও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রের পুরোভূমিতে রয়েছে ময়ূরাক্ষী-তীরের ধূসর-সবুজ ঘাসের আস্তরণ, মধ্যভূমিতে কলসিসহ দুই উপবিষ্ট নারীর অবয়ব, এবং পশ্চাদ্ভূমিতে নদী, নদীর অপর তীর, পাহাড় ও আকাশ। দুই নারীর অবয়বকে স্থাপন করা হয়েছে চিত্রতলের ডানদিকে। বাঁ দিকে কলসি দুটি রেখে অবয়বের সঙ্গে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কেও শিল্পী সচেতন। নদীর মধ্যে নেমে গেছে যেসব মানুষ তাদের অবয়বের ক্ষুদ্রতাই স্পষ্ট করে তুলেছে পরিপ্রেক্ষিতের ধারণাকে। শিল্পীর আঁকা বিভিন্ন মাধ্যমের ময়ূরাক্ষী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষীণতোয়া। কিন্তু এ-চিত্রে জলের ধারা তুলনামূলকভাবে গভীর। রং ব্যবহারে শিল্পী বাস্তব-অতিরেক স্বাধীন মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। ফলে নদীজলের নীলের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে পাহাড়ের নীল; অন্যদিকে চর ও পরপারে রয়েছে বাদামি রং আর আকাশে ধূসরতা। ঘাসের সবুজ রঙেও নানা টোনাল এফেক্ট আনার চেষ্টা শিল্পী করেছেন। সাঁওতাল নারীর নির্মেদ কৃষ্ণবর্ণ শরীরের ঊর্ধ্বাংশের নিরাবরণ রূপ ওই জীবনের বাস্তবতার যেমন পরিচায়ক তেমনি খোঁপায় পলাশ ফুলের অলংকরণ বন্যসৌন্দর্যকেই যেন আভাসিত করে।

সফিউদ্দীন আহমেদের তেলচিত্র-ধারায় কলকাতা-পর্বের এখানেই সমাপ্তি। ১৯৪৭এ ঢাকায় চলে আসার পর পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীবনধারা হয়ে ওঠে তাঁর চিত্রমালার নতুন বিষয়। ঢাকায় নতুন-প্রতিষ্ঠিত আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়ে ১৯৪৯ সালেই আঁকেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হামিদুর রহমানের প্রতিকৃতি। ১৯৫৬ সালে লন্ডন যাওয়ার আগেই বিষয়-অন্বেষণে তাঁর চিত্রধারার নতুনত্বটি আমাদের চোখে পড়ে। ঢাকা শহর ও তার আশেপাশের নিসর্গ ও কর্মকোলাহলে মুখরিত হয় তাঁর এই নতুন চিত্রসমষ্টি; যেমন : ‘গোপীবাগ’ (১৯৫১), ‘বুড়িগঙ্গা-১’ ও ‘বুড়িগঙ্গা-২’ (১৯৫১), ‘মুন্সিগঞ্জ’ (১৯৫১), ‘ধানের হাট’ (১৯৫২), ‘বুড়িগঙ্গা-৩’ (১৯৫২), ‘ধান মাড়ানো’ (১৯৫২), ‘শরবতের দোকান-১’ (১৯৫৪), ‘মুরগির খাঁচা’ (১৯৫৪), ‘মাছ ধরা-১’ (১৯৫৪), ‘কাঠমিস্ত্রি’ (১৯৫৬), ‘সূর্যমুখী’ (১৯৫৬) প্রভৃতি।

হামিদুর রহমানের প্রতিকৃতিটি শিল্পী আঁকেন ইনস্টিটিউটে বসেই এবং এক বৈঠকে। এই প্রতিভাবান ছাত্রটি (পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের অন্যতম নকশাকার হিসেবে খ্যাত) এখানকার শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে পরে লন্ডন চলে যান এবং খ্যাতিমান ভাস্কর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ছোট আকারের ক্যানভাসে আঁকা এ চিত্রটি স্ট্রোকসমৃদ্ধ এবং এতে শিল্পী আলো-ছায়ার ব্যবহার করায় এই তরুণ ছাত্রটির ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুট হতে পেরেছে।

১৯৫১-৫২ কালপর্বে অঙ্কিত অধিকাংশ চিত্রই নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু অক্ষত আছে ‘বুড়িগঙ্গা-৩’ (১৯৫২) ও ‘ধান মাড়ানো’ (১৯৫২) চিত্র দুটি। ‘বুড়িগঙ্গা-৩’ চিত্রে লক্ষণীয় শীতকালীন নদীর অপ্রশস্ত ধারা। এ চিত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছে দু-পাশের চর, যেখানে কৃষক ধান ফলিয়েছে। উভয় পাড়ের চর সোনালি ধানে বিশেষভাবে উজ্জ্বল। নদীর দু-তীরেই বাঁশে-বাঁধা নৌকার সারি। মুন্সিগঞ্জের কাছাকাছি নদীর এই দৃশ্যকে শিল্পী এঁকেছেন ক্যানভাস পেপারে। এক অসাধারণ পরিপ্রেক্ষিতের চেতনাসমৃদ্ধ এ চিত্র। চিত্রতলের অধিকাংশ স্থান নিয়ে গড়া এর পুরোভূমিতে সোনালি ফসলে ভরা চর, নদী ও নৌকা, মধ্যভূমির ক্ষীণ অঞ্চলে দৃষ্টিগ্রাহ্য বহু দূরবর্তী লোকালয়সংলগ্ন বনভূমির দিগন্তছোঁয়া রূপরেখা আর পশ্চাদ্ভূমিতে রয়েছে বি¯তৃত আকাশ। চরের সবটাই যে ফসলের মাঠ তা নয়, আছে তার ফসলহীন উন্মুক্ত অংশও। এ চিত্রে চরে, ফসলের মাঠে কিংবা নদীতে বাঁশ আঁকতে গিয়ে শিল্পী ব্যবহার করেছেন বেশ কিছু সাদা রেখা। তুলির পেছনের শক্ত অংশ দিয়ে ঘষে বের করা হয়েছে এই সাদা রেখাগুলো। এগুলো চিত্রটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। তাছাড়া এ চিত্রে রঙের ব্যবহারও ঐশ্বর্যময়। নদীতীরে বসে তাৎক্ষণিকভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে আঁকা এ চিত্রে পরিস্ফুটিত হয়েছে পূর্ববাংলার একটি অন্তরঙ্গ রূপ।

‘ধান মাড়ানো’ চিত্রটি তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে বসে আঁকা নয়। শিল্পী দুমকায়, কলকাতার নিকটস্থ গ্রামে কিংবা রাজশাহীতে এরকম হাত দিয়ে পিটিয়ে ধান মাড়ানোর দৃশ্য দেখেছেন। সেসব দৃশ্য-অবলম্বী স্কেচের ভিত্তিতে অনেক পরে স্টুডিওতে বসে চিত্রটি ক্যানভাসের ওপর আঁকা। এ চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে রঙের ঘন প্রলেপ। এতে ব্রাশের স্ট্রোকগুলোও বেশ জোরালো। ভারি রঙে কাজ করাই যে শিল্পীর প্রবণতা তা লক্ষণীয় এ চিত্রেও । যে তিনটি অবয়ব এখানে আছে সবগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড গতি আনার চেষ্টা শিল্পী করেছেন। কর্মরত কৃষকের বলিষ্ঠ দেহের গতিভঙ্গিকে শিল্পী রূপায়িত করতে চেয়েছেন। তিনটি অবয়ব স্থাপনের মাধ্যমে বিরচন-কৌশলে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ধরনের ভারসাম্য । বাঁ দিকের অবয়বটি না-থাকলে চিত্রতলের ওই দিকটা ফাঁকা হয়ে যেত। ধান-মাড়ানোর বিষয়টাই এ চিত্রে প্রাধান্য অর্জন করায় প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতের দিকটি গুরুত্ব পায় নি। চিত্রে পাকা ধান ও খড়ের সোনালি রং ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পী সাফল্য দেখিয়েছেন। ধান-মাড়াইরত অবয়বের পায়ের দিকে আলো ফেলা হয়েছে। এজন্য ব্যবহৃত হয়েছে ছোট ব্রাশ। এ চিত্রে শিল্পী আমাদের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকেও মান্য করেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হয়েছে মুরগির ধান খাওয়ার দৃশ্য। পুঙ্খানুপুঙ্খতাকে পরিহার করে একটি সরল বিরচন-কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমে সার্থক হয়ে উঠেছে চিত্রটি ।

‘শরবতের দোকান-১’ চিত্রটিতে অন্বি^ষ্ট হয়েছে ঢাকা শহরের একটি পরিচিত বিষয়। নিচে চাকা, উপরে নানা রঙের পানীয়ের বোতল, তারও উপরে রশি বেঁধে ঝুলানো রঙিন কাপড়, ডানপাশে পানির পাত্র প্রভৃতির মাধ্যমে শরবত বিক্রির দোকান-গাড়িকে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এ চিত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে মোটা রঙের প্রলেপ। স্প্যাচুলা ব্যবহৃত হয় নি। তবে লক্ষণীয় স্ট্রোকের ব্যবহার। অবয়বহীন এ চিত্রে মূলত প্রদর্শিত হয়েছে নানা রঙের চমৎকারিত্বমূলক খেলা। বাঁ দিকে ব্যবহৃত সূর্যের রূপকল্পটিও তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পীর পরবর্তী চিত্রমালায় সূর্যের রূপকল্প ব্যবহারের একটি নিয়মিত প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর মধ্য দিয়ে শিল্পী আশা ও স্বপ্নের আলোকে প্রজ্বলিত রাখার বিষয়টিকেই যেন প্রতীকায়িত করেছেন।

‘মুরগির খাঁচা’ চিত্রটিতেও রয়েছে ঘন রঙের প্রলেপ। ঠাঁটারিবাজারের এ দৃশ্য স্কেচ করে নিয়ে বাড়িতে বসে বোর্ডের ওপরে আঁকা হয়েছে চিত্রটি। খাঁচার দু-পাশে রয়েছে মুরগির বাক্স। আসলে এ চিত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছে শিল্পীর বিরচন-কৌশলটি। চিত্রতলের সুনির্দিষ্ট পরিসরকে নানা আকারে বিভক্ত করে তার মধ্যে আলো-ছায়া ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য । খুব বেশি সংখ্যক বা বিপরীতমুখী রং শিল্পী ব্যবহার করেন নি, কিন্তু বিভিন্ন বহির্রেখা ও ছায়া ব্যবহারের মাধ্যমে আকারগুলোকে স্বাতন্ত্র্য দান করা হয়েছে।

‘মাছ ধরা-১’ চিত্রটির বিরচন-কৌশলটি একেবারেই সরল। মাথলা মাথায় একটি মানুষ নৌকায় দাঁড়িয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে মাছ ধরার প্রতি একাগ্রতা ফুটে উঠলেও বড়শি ধারণসহ অবয়বের চিত্রায়ণে পুঙ্খানুপুঙ্খতার আশ্রয় শিল্পী নেন নি। বরং এ চিত্রে শিল্পী জোর দিয়েছেন পানির ওপর নৌকার অবস্থানের ফলে উদ্ভূত বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার দিকে। নৌকার আয়তন ও ওজনে পানিতে যে চাপ পড়ে এবং তাতে পানির অভ্যন্তরে যে আলোড়ন ও তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সেটাকেই এ চিত্রে গুরুত্ব -সহকারে রূপায়িত করেছেন শিল্পী । এই রূপায়ণসূত্রেই অন্বিষ্ট হয়েছে লোককলার রেখা Ñ ঘূর্ণ্যমান বাঁকা রেখা। এরূপ রেখার মাধ্যমেই পরিস্ফুটিত হয়েছে পানির অন্তশ্চাপ । সেই সঙ্গে এ চিত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে রঙের ব্যবহার। ব্যবহৃত হয়েছে একই পানির নানারূপ রং। পানির নীল রংটিকে ভেঙে দেওয়ার অভিপ্রায়েই এটা করা হয়েছে। অন্যদিকে অবয়ব নির্মাণেও লক্ষণীয় লোককলার প্রভাব। এভাবে শিল্পীর উল্লেখযোগ্য ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত চিত্র হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়ে আছে।

লোককলার এই প্রভাব শিল্পীর ‘কাঠমিস্ত্রি’ চিত্রটিকেও স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। পূর্ববর্তী চিত্রটির মতো বিষয় হিসেবে লোকজীবন আশ্রিত হওয়ার কারণেই যে এ-চিত্র লোক-অনুগামী তা কিন্তু নয়। এ চিত্রেও অবয়ব নির্মাণে লোককলার বৈশিষ্ট্যকে শিল্পী গ্রহণ করেছেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, লোকশিল্পের নির্জীব চরিত্রকে ভেঙে দিয়ে শিল্পী এ চিত্রকে জীবনের কর্মকোলাহল দিয়ে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। জীবন-চিত্রণের মাধ্যমে তিনি লোকমোটিফ ব্যবহার করেছেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে লাঙ্গলবন্ধের মেলায় গিয়ে শিল্পী দেখেছিলেন কাঠের ঘোড়া। লোকশিল্পের এই উপাদানকে নিয়ে পরে তিনি চিত্রাঙ্কনের পরিকল্পনা করেন। ওই কাঠের ঘোড়ার নির্মাতাকেই প্রধান বিষয় করে এমন একটি চিত্র তিনি আঁকেন যাতে জীবনের যোগসূত্রসহ লোকশিল্পের একটি নতুন ভাষ্য তৈরি হয়। এ চিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এখানে রয়েছে প্রচুর রেখার কাজ। এর অধিকাংশই আবার ঋজু রেখা। রেখার এই ঋজুতা চিত্রটিতে ব্যাপক গতি সঞ্চার করেছে। চিত্রটিতে রঙের বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা শিল্পী করেন নি। ফলে অবয়বের গাত্রবর্ণের সঙ্গে কাঠের রং মিশে একাকার হয়ে গেছে। সফিউদ্দীন আহমেদের তেলচিত্রমালায় নতুন সংযোজন হিসেবে এ চিত্রটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

‘সূর্যমুখী’ ফুল নিয়ে আঁকা জড়জীবনচিত্রে হুবহু ধারণ করা হয়েছে একটি মাটির পাত্রে সাজানো পাঁচটি সূর্যমুখী ও নিচে পড়ে-যাওয়া তার কয়েকটি পাতাকে। নিজ বাড়িতে আঁকা এ চিত্রে ফুল, পাতা ও পাত্রের যথার্থ রংকে ফুটিয়ে তোলারই চেষ্টা করা হয়েছে। বস্তুগুণকে যথার্থভাবে রক্ষা করাই চিত্রটির বৈশিষ্ট্য। সে-কারণে শুধু রং নয় এর সতেজতা রক্ষার দিকেও ছিল শিল্পীর সতর্ক দৃষ্টি। ফুলগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যাতে ক্যানভাসের ভেতরেই তার স্থান সংকুলান হয়। জড়জীবন অনুশীলনে হুবহু অনুকরণই একমাত্র রীতি নয়, কখনো কখনো শিল্পী সৃজনশীলভাবে নিজস্ব পরিকল্পনার বাস্তবায়নও ঘটান। সফিউদ্দীন আহমেদের ক্ষেত্রে আমরা উভয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখি।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।