ড্রাই পয়েন্ট

সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্রের যেসব মাধ্যমে দক্ষতার সঙ্গে চিত্র রচনা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে : উড-এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, মেটাল-এনগ্রেভিং প্রভৃতি। এর মধ্যে উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমটি ছাড়া বাকিগুলি ইন্টালিও (অন্তর্লীন) পদ্ধতির। অন্তর্লীন পদ্ধতিতে ধাতুপাতে বুরিন বা নানা ধরনের বুলি, হিরের বা কার্বোরান্ডাম টুকরো বসানো কলমে গভীর-অগভীর আঁচড় কেটে, অ্যাসিডে খাইয়ে, বারনিশার ইত্যাদি দিয়ে ঘষে ছাপার অংশ ধাতুপাতের লেভেল থেকে নিচু করে ছবি তৈরি করা হয়। এরূপে তৈরী ধাতুপাতে কালি বুলিয়ে আঁচড় না-কাটা বা অ্যাসিডে না-খাওয়ানো অংশ থেকে কালি মুছে ভেজা কাগজে রোলারের চাপে ছাপ নিলে আঁচড়-কাটা ও অ্যাসিডে খাওয়ানো অন্তর্লীন অংশ থেকে কালির ছাপ কাগজে উঠে এসে ছবি তৈরি হয়।

ড্রাই পয়েন্ট একটি সরাসরি মাধ্যম। এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট ইত্যাদি মাধ্যমে যেমন স্টপ-আউট দিয়ে ঢেকে অ্যাসিডে খাইয়ে নানা ধরনের রেখা, টেক্সচার বা বুনোট এবং টোন বা বর্ণবিভার রকমফের তৈরি করা যায় এখানে তেমনটা সম্ভব নয়। এ মাধ্যমে ধাতবপাতে সরাসরি রেখা এঁকে তার ছাপ নিয়ে ছবি সৃষ্টি করতে হয়। ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এখানে নিডল বা পিনের সূচিমুখ রেখা কাটার সময় লাঙলের ফলা যেমন দুপাশে মাটি তুলে এগোয় তেমনি রেখার দুপাশে সূক্ষ্ম ধাতবকণা বা ওকড়া তুলে দেয়। এই সূক্ষ্ম ধাতবকণাসহ ছাপ নেওয়ার সময় কাগজে রেখাগুলো কোমল মোলায়েম রূপ ধারণ করে। এ মাধ্যমে ধাতুপাতের অধিকসংখ্যক ছাপ নেওয়া সম্ভব হয় না, কারণ রেখার দু-পাশে জমে-ওঠা সূক্ষ্ম ধাতবকণা ক্রমশ ক্ষয়ে যায় এবং তাতে ছাপচিত্রে রেখার মোলায়েম ভাব হ্রাস পায়। এ-কারণে ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমটি বেশ কঠিন ও শ্রমসাধ্য। হাত পিছলে বা ফসকে গিয়ে রেখা প্রত্যাশিত পথে না-এগোলে ছবি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে অতি সুদক্ষ হাতে সুনিশ্চিত হয়েই এ মাধ্যমে রেখা টানতে হয়।

ড্রাই পয়েন্টের সুদক্ষ শিল্পী ছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দে। মুকুল দে-র ড্রাই পয়েন্টের চিত্র ছাত্র সফিউদ্দীনের কাছে কাব্যের আবেদন সৃষ্টি করায় তিনি এ মাধ্যমটির প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু আর্ট স্কুলের পাঠক্রমে এচিং কিংবা ড্রাই পয়েন্ট ছিল না। এজন্য প্রয়োজনীয় মেশিনও ছিল না আর্ট স্কুলে। তা ছিল রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত স্টুডিওতে। সফিউদ্দীন আহমেদকে ১৯৪৪-৪৬ কালপর্বে ওই শিক্ষকের স্টুডিওতে এ মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পান।

ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে আঁকা সফিউদ্দীন আহমেদের প্রথম চিত্রকর্মটির বিষয় ‘দুমকার শালবন ও মোষ’ (১৯৪৪)। এ চিত্রে শালগাছগুলোর দীর্ঘতার পটভূমিতে প্রকট করে তোলা হয়েছে মাটি ঘেঁষে-চলা মোষগুলোর ক্ষুদ্রতাকে। এ চিত্রে নিসর্গের আবেদনটিই মুখ্য। আকাশকে ঢেকে ফেলা হয়েছে গাছের উচ্চতা দিয়ে। চিত্রের বিরচনগত বিন্যাস থেকে বৃক্ষের শীর্ষদেশ ছাঁটাই করে ফেলায় এই উচ্চতা আমাদের দৃষ্টিকে আরো প্রসারিত করে। কাট অফ এজ পদ্ধতিতে রূপগুলির অংশবিশেষ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় ফ্রেমের বাইরেও তৈরি হয়ে যায় দৃশ্যের এক অদেখা বিস্তার। প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে আমরা মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু কত ছোট ও সংক্ষিপ্ত সেই অনুভূতিকেও এখানে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে। সফিউদ্দীন আহমেদের প্রকৃতি-দর্শন দুমকাতেই পূর্ণতা লাভ করে। এর আগে তিনি বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে প্রকৃতির অনুশীলন করেছেন; তাঁর জলরং-চিত্রে এর পরিচয় আমরা পাই। কিন্তু দুমকাতেই প্রকৃতির বিশালত্বকে প্রথম অনুভব করেন তিনি। বিষয় ও শৈলী উভয় দিক থেকেই চিত্রকর্মটি সার্থক। চিত্রটির আবেদন অনেকটা কবিতার মতো। ধাতুপাতে শক্ত সুচের আঁচড়ে রেখাগুলোর দুপাশ যেভাবে ওকড়াজাতীয় অমার্জিত রূপ গ্রহণ করে তাতেই জন্ম নেয় এক ধরনের কবিতা। আলো-ছায়ার ব্যবহারেও চিত্রটি উৎকর্ষ লাভ করেছে। একটি বৃক্ষের কাণ্ডকে বিশেষভাবে কালো করে তোলা হয়েছে, বিপরীতক্রমে অন্যগুলোতে আলো ফেলা হয়েছে অধিক মাত্রায়।

‘দুমকা-১’ (১৯৪৪) চিত্রটিতে কিছুটা উঁচু জায়গা থেকে দেখা হয়েছে বিষয়গুলোকে। গাছগুলো আগের চিত্রের মতো অতটা লম্বা নয়। শাখা-প্রশাখা ও ঘন পত্রশোভিত গাছের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেঁকে। চিত্রের পুরোভূমিতে দুজন ও মধ্যভূমিতে আরো তিনজন সাঁওতাল নারী মাথায় কিছু বহন করে গমনরত। এ চিত্রটিও আলো-ছায়ার ব্যবহারে উৎকর্ষমণ্ডিত। এ বছরেই তিনি সম্পন্ন করেন দুমকা-সংক্রান্ত আরো দুটি চিত্র। এর মধ্যে ‘দুমকা-২’-এ চিত্রিত হয়েছে পাহাড় ও সামান্য বৃক্ষরাজিসহ আকাশ ও দুমকার উন্মুক্ত প্রান্তর; আর ‘ময়ূরাক্ষী’তে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ক্ষীণ জলধারাসহ বহমান ময়ূরাক্ষীর শীর্ণ রূপ। কর্মজীবী সাঁওতাল নারীকুল হেঁটেই পার হয়ে যাচ্ছে এই নদী।

১৯৪৪ সালে একই মাধ্যমে আঁকা হয়েছে কলকাতা আর্ট স্কুলের একটি কক্ষের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য। এই চিত্রের কেন্দ্রভূমিতে রয়েছে একটি ইজেল, যাতে সাজানো আছে একটি সাদা ক্যানভাস। রেখার বিচিত্র কারুকাজ দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে কক্ষের অন্যান্য জিনিসপত্র। ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে কলকাতা আর্ট স্কুলের এক মডেলকে চিত্রিত করা হয়েছে এর পরের বছর (১৯৪৫)। পেশাদার এই মডেল দীর্ঘকাল যাবৎ ওই স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দাড়ি ও লম্বা চুলের ওই মডেলের মাথায় থাকত লাল টুপি। এই প্রতিকৃতি-চিত্রের বৈশিষ্ট্য হল, এখানে পূর্ণাবয়বকে প্রাধান্য না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শুধু মুখমণ্ডলকে। বিশেষভাবে তাৎপর্য অর্জন করেছে তার মুখের অভিব্যক্তি। অতি অল্প রেখার ব্যবহারে সম্পাদিত হয়েছে এ চিত্রকর্ম।

এই মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রের বিষয় ‘ময়ূরাক্ষী তীরে উপবিষ্ট দুই সাঁওতাল রমণী’ (১৯৪৫)। একই বিষয় নিয়ে শিল্পী এঁকেছেন একটি তেলচিত্র, যেখানে এ দুই নারীর খোঁপায় গোঁজা ফুলের রংটি স্পষ্ট। চিত্রের মধ্যভূমিতে কিছুটা বাঁকা করে স্থাপন করা হয়েছে এই দুই অবয়বকে। শূন্য কলসসহ এই দুই নারীকে ধারণ করা হয়েছে তাদের পেছন থেকে। নদীর দিকে তাদের চোখ। এ দুই নারীর বাঁ পাশেরটির বাঁ পাটি ভাঁজ করা, বাঁ হাতটি উরুর ওপর রাখা; ডান হাতটি দিয়ে মাটির ওপর ভর করে কিছুটা পেছনে হেলে আছে সে। দুজনেরই শরীরের উপরিভাগ এক চিলতে কাপড় ছাড়া প্রায় উদোম। এটিই তাদের স্বাভাবিক আবরণ। এ ছাড়া অন্য দুই নারী কলসি মাথায় নেমে গেছে ময়ূরাক্ষীর ক্ষীণ জলধারার মধ্যে, পানি হাঁটু সমানও নয়। দূরত্বের কারণে তাদের অবয়ব যেমন অস্পষ্ট তেমনি খর্ব। নদীর অপর তীরে পশ্চাদ্ভূমিতে অস্পষ্ট পাহাড়। এ চিত্রে উপবিষ্ট দুই নারীই প্রাধান্য অর্জন করায় আর সব কিছু ধূসরতায় আচ্ছন্ন। এ চিত্রে শিল্পীর বিরচনের দক্ষতা যেমন অনুভবগ্রাহ্য তেমনি শিল্পীর অবস্থানটিও উপলব্ধিযোগ্য। শিল্পীর অবস্থান নারী দুটির পেছনে বাঁদিকে যেখান থেকে এদের সবটা দেখতে পাওয়া যায়। এ চিত্রে ধারণ করা হয়েছে একটি বিশেষ মুহূর্তকে, কিন্তু তা প্রকাশ করছে সাঁওতাল নারীজীবনের এক বৃহৎ ও সর্বকালীন আখ্যান।

এ মাধ্যমে আঁকা তাঁর সর্বশেষ চিত্রটির নাম : ‘শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট’ (১৯৪৫)। হুবহু একই বিষয় ও দৃশ্য অবলম্বনে এ নামেই রচিত হয়েছে তাঁর একটি রেখাচিত্র। সতীর্থ সত্যেন ঘোষালসহ সফিউদ্দীন আহমেদ শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ১৯৪৫ সালে। কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চিঠি নিয়ে শিল্পী নন্দলাল বসু, শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। রেখাচিত্রটি সে-সময়েই অঙ্কিত; পরে এরই ভিত্তিতে কলকাতায় ফিরে ড্রাই পয়েন্টে আঁকেন এ চিত্রটি। বীরভূমের রুক্ষ মাটির বুক চিরে দীর্ঘ তালবৃক্ষের সারি, তারই মধ্য দিয়ে গরুর গাড়িতে করে কিংবা পদব্রজে চলছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনধারা। আলোছায়ার ব্যবহারে ও পরিপ্রেক্ষিতের সুচারুতায় চিত্রকর্মটি সার্থকতা লাভ করেছে। পুরোভূমির তালসারির তুলনায় দূরবর্তী পশ্চাদ্ভূমির তালসারি অস্পষ্টতায় ধূসর। আলোর বিপরীতে অঙ্কিত না-হওয়ায় সমগ্র দৃশ্যপট আলোকিত। তালবৃক্ষগুলো তার স্বাভাবিক রঙে অনুজ্জ্বল। পুরোভূমির সবচেয়ে কাছের গাছ দুটি সবচেয়ে স্পষ্ট, কিন্তু কাছে হওয়ায় গাছের শীর্ষভাগ পুরোটা চিত্রের অংশ হতে পারে নি। কাছে-দূরের পরিপ্রেক্ষিতটি স্পষ্ট করার জন্য এটা সচেতনভাবে করা হয়েছে। এটা শিল্পীর বিরচনগত দক্ষতারও প্রমাণ। কাছের এই দুটি গাছ চিত্রটিকে যেন দূরে নিয়ে যাচ্ছে এমন অনুভূতির সৃষ্টি হয়। পথটা কিছুটা বেঁকে উপরের দিকে উঠে গেছে। রেখার দিক থেকে দেখলে কিছু রেখা আনুভূমিক বা বাঁকা ধরনের, কিছু উল্লম্ব প্রকৃতির। প্রথমটি পথরেখা সৃষ্টিতে এবং দ্বিতীয়টি বৃক্ষরূপ অঙ্কনে সহায়ক হয়েছে। আনুভূমিক রেখার মধ্যে যে-প্রশান্তি আর উল্লম্ব রেখার মধ্যে যে-দৃঢ়তা এই দুয়ের সমাহারে চিত্রটি হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।