কপার এনগ্রেভিং

কলকাতা পর্বে উড এনগ্রেভিং মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের পর ঢাকায় কিছু কাজ করলেও লন্ডন যাওয়ার পর সফিউদ্দীন আহমেদ এ মাধ্যমে আর কোনো কাজ করেন নি। লন্ডনে তিনি এনগ্রেভিং মাধ্যমে যে উচ্চশিক্ষা নেন সেটি আর কাঠে নয়, ধাতুতে বা তাম্রপাতে। তাম্রপাতে বুরিনের সাহায্যে সরাসরি গভীর অগভীর রেখা কেটে এ পদ্ধতির চিত্র নির্মিত হয়। ধাতবপাতে একটি রেখা কাটার অর্থ সেটিই চূড়ান্ত। প্রত্যাহার করার বা মুছে নতুন একটি রেখা তৈরির সুযোগ এখানে নেই। ধাতবপাতে আকাক্সিক্ষত রেখা কাটতে হলে হাতের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে জরুরি। সফিউদ্দীন আহমদের শক্তির দিকটি তাম্রতক্ষণ (কপার এনগ্রেভিং) মাধ্যমের চিত্রমালায় আরেকবার প্রমাণিত। ১৯৫৭-৫৮ কালপর্বে এ মাধ্যমে তিনি রচনা করেন : ‘জেলের স্বপ্ন’, ‘হলুদ জাল’, ‘কম্পোজিশন’ ও ‘গুনটানা’।

লন্ডনে প্রথম এনগ্রেভিং মাধ্যমে রচিত চিত্রটির নাম ‘জেলের স্বপ্ন’ (১৯৫৭)। এ চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে নৌকা, জেলে ও মাছের রূপকল্প। পরিচিত অবয়বকে ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে এমন বিকৃত করা হয়েছে যে, চিত্রতলের কেন্দ্রে যেটিকে মাছের ইমেজ বলে মনে হয় সেটি আসলে জেলের পা। এ চিত্রে সরু-মোটা নানা রকম রেখার নানা মাত্রা ও বৈচিত্র্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একটি রেখা চলে যাচ্ছে আরেকটি রেখার ওপর দিয়ে কিংবা পেচিয়ে যাচ্ছে রেখাগুলো। মাছের আকৃতি নিয়ে, আবার তাকে ভেঙে দিয়ে বিকৃত করে চিত্রকর্মটি রচিত হয়েছে। রেখাকে কতভাবে ব্যবহার করা যায় তার একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এ চিত্রে। চিত্রের ডানদিকের ফর্মের মধ্যে বিন্যস্ত হয়েছে মাছের অবয়ব। এই চিত্রকর্মটি চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার আগে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করেছে। শিল্পী এরকম তিনটি স্তরের ছাপছবি রেখেছেন। তা থেকে শিল্পীর ভাবনাবিন্দু ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়গুলো অনুধাবন করা যায়। প্রথমে একটা বিষয়বস্তুকে ভেবে নিয়ে শিল্পী কতকগুলো রেখার কম্পোজিশন সৃষ্টি করেন। তাতে সরু, সূক্ষ্ম ও ঈষৎ স্থূল রেখার বিন্যাস আমরা লক্ষ করি। বিষয়বস্তুর পরিধি যত বাড়তে থাকে রেখার পরিমাণও তত বেড়ে ওঠে। তারপর শিল্পীর চিন্তনক্রিয়ায় ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে পুরো চিত্রের গঠন-কাঠামো। তাতে নানা গড়ন, পরিসর ও বিরচনের একটা ভারসাম্য ও সুচারু বিন্যাস সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াটি এ চিত্রে লক্ষণীয়। প্রথম পর্যায়ে আমরা রেখার এমন ব্যবহার দেখি যাতে চিত্রটিতে সৃষ্টি হয়েছে টেনশন ও কাউন্টার টেনশন। পাশাপাশি নানা গড়নের বিপরীতে কাউন্টার ফর্ম সৃষ্টির প্রবণতাও লক্ষণীয়। গড়নগুলো একটার সঙ্গে একটা পরস্পর-সম্পর্কিত। লন্ডন যাওয়ার পরে শিল্পীর চিত্রকর্মে অবয়ব যে অস্পষ্ট হয়ে গেছে Ñ সেই বৈশিষ্ট্যটিও লক্ষণীয় এ চিত্রে । পরিবর্তে প্রাধান্য অর্জন করেছে ফর্ম।

চিত্রকর্মের দ্বিতীয় পর্যায়ে বিরচনের মূল কাঠোমো অক্ষুণœ রেখে রেখার বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। একক ও হালকা রেখার তীক্ষèতাকে কোথাও কোথাও দ্বৈত, ঘন ও দৃঢ় করে তোলা হয়েছে। অপূর্ণ রেখাকে দান করা হয়েছে পূর্ণতা। ফলে চিত্রটি হতে পেরেছে আরো সুন্দর, অর্থময় ও ব্যঞ্জনাদীপ্ত। তৃতীয় পর্যায়ে আমরা শুধু রং ব্যবহার করতে দেখি। ব্যবহৃত হয়েছে শুধু একটি রংই । চিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রং একেবারেই হালকা, যতই প্রান্তের দিকে এগিয়ছে রং তত গাঢ় হয়েছে। চিত্রের কেন্দ্রে আলো ফেলার এই কৌশলটি পরবর্তী কিছু চিত্রেও লক্ষণীয়।

‘হলুদ জাল’ (১৯৫৭) চিত্রটিতে এনগ্রেভিংয়ের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে সফটগ্রাউন্ড বারনিশের মাধ্যমে টেক্সচার তৈরির প্রক্রিয়াটিও। রেখা দিয়ে যেমন উপস্থাপিত হয়েছে জালের প্রতীকী বিন্যাস তেমনি সফটগ্রাউন্ড বারনিশ-প্রক্রিয়ায় ধাতুপাতে মোজা ও মশারির কাপড়ের ছাপ ফেলে জালের আবহটিকে করে তোলা হয়েছে আরো ব্যাপক। কাপড় কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে একবার, কোথাও একাধিকবার। যেখানে একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে জালের গাঢ় টোন। ডান পাশে এক জায়গায় কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। পুরো চিত্রটিকে ডানপাশের পুরোভূমিতে এনে শেষ করা হয়েছে। সেখানে জালের শেষ প্রান্ত, সেখানে মাছের চোখের রূপকল্প। ভেতরে ইমেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ছোট নৌকার প্রতীক। এ চিত্রে এনগ্রেভিং-মাধ্যমে অঙ্কিত রেখার মধ্যে রয়েছে প্রবল গতি। পানিতে জাল নামানো-ওঠানোর সময় যে গতির সঞ্চার হয় সেই গতিকে এখানে রেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাছাড়া জাল টেনে তোলার সময় যেমন নানা কোণ সৃষ্টি হয় তারও ব্যবহার ঘটেছে এ চিত্রে। দ্বিতীয় পর্যায়ে চিত্রটিতে ব্যবহৃত হয়েছে নানা রং : লাল, নীল, হলুদ প্রভৃতি। রঙের এই ব্যবহারটি শিল্পীর মনঃপুত না-হওয়ায় তিনি তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে তাতে পরিবর্তন আনেন। রঙের মাত্রা অনেক কমিয়ে দেন। এ চিত্রে রং লাগানো হয়েছে ড্যাবিং পদ্ধতিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রঙের অতি ব্যবহারে তা জলচিত্রের রূপ ধারণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ের চিত্রটিতে রং ব্যবহারের ফলে চিত্রতলের বাঁ পাশের পশ্চাদ্ভূমির টেক্সচার ঢেকে গেছে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে চিত্রের ডান দিকে চোখের নিচে একটা নীল ফর্ম আছে, যেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে বাদ পড়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে যেখানে ছিল নীলের প্রাধান্য সেখানে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘটে হলুদের প্রাধান্য। নীল এমন হালকা হয়ে যায় যে নীল বলে আর চেনাই যায় না। লালও একইভাবে হালকা রূপ ধারণ করে। ডানদিকে পশ্চাদ্ভূমিতে যেখানে ছিল নীল, সেখানে হলুদ এসে তার স্থান দখল করে। এসব পরিবর্তন-প্রক্রিয়ায় অপরিবর্তিত কাঠামোর মধ্যেই চিত্রের রূপ যায় পাল্টে। শিল্পীর নিরীক্ষাপ্রবণতার গভীরতাকে আমরা এর মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি।

‘কম্পোজিশন’ (১৯৫৮) শীর্ষক চিত্রটি রচনায় এনগ্রেভিং ছাড়াও আশ্রয় নেয়া হয়েছে অ্যাকুয়াটিন্ট ও ডিপএচ মাধ্যমের। প্রথমে আঁকা হয়েছে এনগ্রেভিংয়ের রেখা। পরে ব্যবহৃত হয়েছে অন্যান্য মাধ্যম। নৌকা ঝড়কবলিত হলে পালসহ নৌকার কী অবস্থা দাঁড়ায় এখানে চিত্রিত হয়েছে তারই একটি কল্পিত কাঠামো। শিল্পী নিজে কলকাতায় কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে লক্ষ করেছেন এর তীব্র গতি ও ধ্বংসাত্মক রূপ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ঝড়ের তাণ্ডবে হালভাঙা পালছেঁড়া নৌকার বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কল্পনা করে এ চিত্রে গতি সঞ্চার করেছেন। ডিপএচ মাধ্যমে নৌকা ও পালের অংশে ব্যবহৃত হয়েছে পূর্ণগর্ভ কালো রং। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ভাবটা দূর করে অনেকটা ইমবস কোয়ালিটি সৃষ্টি করা হয়েছে, অর্থাৎ এই অংশটাকে অধিকমাত্রায় অ্যাসিডে খাওয়ানোর ফলে কালোটা চিত্রতল থেকে যেন উপরে উঠে এসেছে। নৌকা ও পালের ইমেজের মধ্যেই আবার নিয়ে আসা হয়েছে অ্যাকুয়াটিন্টের দানাদার বৈশিষ্ট্য। অ্যাকুয়াটিন্ট করার পর বারনিশার দিয়ে ঘষে কোনো কোনো অংশকে হালকা করা হয়েছে। তা না করলে পূর্ণগর্ভ কালোতে গতি অনেকটা আটকে যেত। তবে স্বীকার্য যে, অ্যাকুয়াটিন্টের গুণাবলির দিক থেকে এ চিত্র ততটা উন্নত নয়। এর প্রথম স্তরটিতে শুধু এনগ্রেভিংয়ের রেখা। দ্বিতীয় স্তরে পাল ও নৌকার ইমেজ সৃষ্টি; ডিপএচ ও অ্যাকুয়াটিন্টের ব্যবহারসহ সাদা-কালোর বিন্যাস। তৃতীয় স্তরে ব্যবহৃত হয়েছে ঈষৎ লাল (রেডিশ) রং। তাতে দেখা যায়, রংটি চিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মানানসই নয়। ফলে চতুর্থ স্তরে রংটি প্রত্যাহার করে একেবারেই হালকা নীলাভ রং দিয়ে চিত্রটির চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।

‘গুণটানা’ (১৯৫৮) চিত্রটি শুধু এনগ্রেভিং মাধ্যমে আঁকা। নৌকাকে স্রোতের বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে শক্তি প্রয়োগ গুণটানার মধ্য দিয়ে ঘটে তার অন্তর্নিহিত বেগ ও আবেগ চিত্রিত হয়েছে এখানে রেখার সাহায্যে। শিল্পীর মতে, নিজ জীবনের সংগ্রামশীল অগ্রযাত্রাকে নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য প্রতিনিয়ত তাঁকে যে বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে সেটাই এখানে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। নৌকা নয়, এ যেন জীবনকেই টেনে নিয়ে যাওয়া। বিষয়টি শুধু গুনটানার হলে নৌকা এবং মাঝি দুজনই প্রাধান্য পেত। কিন্তু তা পায় নি। অবয়ব দুটি এখানে প্রতীক মাত্র। আসলে নিজ জীবনের টেনশনকেই যেন তিনি চিত্রের মধ্যে সঞ্চার করতে চেয়েছেন। কেননা টেনশন না থাকলে অবয়বের মধ্যে এমন জোর আসত না। অবয়ব যে বেঁকেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে তার মূলে রয়েছে ওই গতি ও টেনশন। শক্তি প্রয়োগে স্রোতের বিপরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে চেষ্টা তার মূলে থাকে প্রচণ্ড গতি। সেটিই এখানে চিত্রিত হয়েছে। তবে বাস্তবতার বাইরেটা নয় ভেতরের সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। এনগ্রেভিং কত সমৃদ্ধ হতে পারে এটি তার উত্তম উদাহরণ। সরু মোটা নানা তীক্ষè রেখার অসাধারণ স্বচ্ছন্দ ব্যবহার এখানে ঘটেছে। চিত্রতলের বাঁ দিকের পশ্চাদ্ভূমিতে দেখানো হয়েছে নৌকার পেছনটা। স্রোতের বিপরীতে তীব্র টানে সবকিছু বেঁকেচুরে যাচ্ছে। বাতাসের বিপরীতে গেলে যেমনটা হয়। এখানে ফুটে উঠেছে পালহীন নৌকার নানা ভাঙচুরকৃত গড়ন। রেখার তীক্ষèতা ও বলিষ্ঠতার এক উত্তম দৃষ্টান্ত এ চিত্র।

এ চিত্রের চারটি স্তর লক্ষণীয়। প্রথম স্তরে তিনি রেখার ভাঙচুরসহ তীক্ষèতাকে প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষত সরু রেখার পরিমাণ আরো বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত আবেগকে আরো জটিল করে তোলা হয়েছে। তৃতীয় স্তরে রেখা আর না বাড়িয়ে অবয়বদ্বয়ের ওপর আলো ফেলে চিত্রতলকে অতি হালকাভাবে কালো রং ব্যবহারের মাধ্যমে করে তোলা হয়েছে অনুজ্জ্বল । চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্যায়ে হালকা কালোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে অতি হালকা নীলের আভা।

এ চিত্র রচনায় আধুনিক ছাপচিত্রের জনক বলে বিশ্বখ্যাত ছাপচিত্রী এস.ডব্লিউ. হেটারের প্রভাব লক্ষণীয়। শিল্পী এ প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সময়ের। ফলে ওই মাধ্যমে দীর্ঘকাল তিনি আর কোনো কাজ করতে পারেন নি। ১৯৫৮ সালের পর এ মাধ্যমে তিনি আবার কাজ করেন ১৯৮০ সালে। মাঝখানে ব্যবধান বাইশ বছরের। ছবিটির নাম ‘কান্না’।

‘কান্না’ (১৯৮০) শিরোনামের চিত্রটিতে শিল্পী মূলত এঁকেছেন ‘ঝড়ের চোখ’। যে-ঝড়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দুর্ভোগ-দুর্গতি ও কান্নার উৎসবিন্দু। ঝড়ের ভেতরে একটি চোখ থাকে, আবহাওয়াবিদরা যেমনটা বলেন, সেই চোখকে কেন্দ্র করেই ঝড়টি আবর্তিত হয়, ক্রমশ শক্তি অর্জন করে এবং পরিণামে সর্বনাশা আঘাত হেনে প্রকৃতি ও লোকালয়ের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। ঝড়ের এই চোখটিকেই শিল্পী এ চিত্রে রূপময় করেছেন। ঝড়ের প্রবল অভিঘাতে চোখ যেন উড়ে যাচ্ছে। চিত্রের মাঝ বরাবর আলো ফেলে তৈরি করা হয়েছে একটি কেন্দ্র। ঝড়ের কেন্দ্রভূমিতে যে তীব্র গতি থাকে এই আলো ও চোখের ঘূর্ণ্যমান বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে তাকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে। এ চিত্রে ঝড়ের গতিই মূল। এখানে বায়ান্ন কিংবা একাত্তরের কোনো চিন্তাভাবনা সক্রিয় নয়। ঝড়ের গতিকে তীব্রতর করার জন্য কম্পোজিশনে একটা বৃত্ত বা চক্র তৈরি করা হয়েছে। চিত্রের ডান দিক থেকে যার শুরু এবং বাঁ দিক হয়ে যা আবার ডান দিকে চলে এসেছে। কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে এ চিত্রে শিল্পীর দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। এখানে সরু ও মোটা, সোজা-বাঁকা, ডিম্বাকার, বর্তুলাকারসহ নানারকম রেখা যেমন আঁকা হয়েছে তেমনি চোখের আকারও দেওয়া হয়েছে বিচিত্র ধরনের। সব মিলে চিত্রে যে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে সেখানেই শিল্পীর নান্দনিক ভাবনার সাফল্য। চিত্রটির ‘কান্না’ নামের সার্থকতা এখানেই যে, ঝড়ের ওই চোখের মধ্যেই নিহিত থাকে অগণিত মানুষের কান্নাার উৎস।

তাম্রতক্ষণ মাধ্যমের চিত্রমালায় ‘কান্না’ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রভুবনে চোখ এক নতুন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমে তা গতি ও শক্তির তীব্রতা অনুভবের প্রতীক রূপে উপস্থাপিত হলেও ক্রমে তার তাৎপর্য রূপান্তরিত হয়েছে। একই মাধ্যমে তিনি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে পরে আরো তিনটি চিত্র আঁকেন (‘একুশে স্মরণে’, ‘একাত্তরের স্মৃতি’ ও ‘একাত্তরের স্মরণে’) Ñ যেখানে চোখ হয়ে উঠেছে জাতীয় চিন্তা-চেতনা ও মননের প্রতীক। উল্লেখ্য যে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে যখন তিনি বন্যা, নৌকা, মাছ ও জালের রূপকল্প নিয়ে ছবি আঁকেন তখনই এগুলো মনের অজান্তে একেকটা চেখের আকার নিয়ে নেয়, বিশেষ করে মাছ ও নৌকা। তবে আশির দশকে তাম্রতক্ষণ পদ্ধতির চিত্রমালায় চোখ সরাসরি বহন করে সম্পূর্ণ নতুন এক চেতনাগত অর্থ ও তাৎপর্য।

‘একুশে স্মরণে’ (১৯৮৭) চিত্রটি তাম্রতক্ষণ মাধ্যমে সম্পাদিত হলেও প্রিন্ট নেওয়ার পর চিত্রে পেনসিল দিয়ে কিছু টোন দেওয়া হয়েছে। সফিউদ্দীন আহমেদ সাধারণত ছাপচিত্রের ব্যাপারে বিশুদ্ধপন্থী। প্রিন্ট নেওয়ার পর তাতে হাতের কোনো কাজ করা তাঁর নীতিবিরোধী। কিন্তু এই চিত্রে তিনি নিজ বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। কারণ প্রিন্ট নেওয়ার পর চিত্রটি যেন কিছু টোন দাবি করেছে। যে-দাবি শিল্পী না মিটিয়ে পারেন নি। ফলে এটি কিছুটা মিশ্র-মাধ্যমের চিত্র হয়ে গেছে। পুরো চিত্র জুড়ে পাশ থেকে দেখা (প্রোফাইলে) একটি মুখাবয়ব Ñ তাতে আছে নাক, মুখ, চোখ ও চোখের জল। চোখ ও চোখের জলের একাধিক ফর্ম মাথা ও মুখমণ্ডল জুড়ে বিন্যস্ত। বায়ান্নর একুশের সেই জাতীয় আবেগ, তার রক্তাক্ত অশ্র“পাতের স্মৃতি তা শুধু একক ব্যক্তির কিংবা একজন শিল্পীর মস্তিষ্ককোষেরই বিষয় না তা সমগ্র দেশের সংবেদনশীল সকল মনের অনুভূতিতে বি¯তৃত। এই বিস্তারকেই তিনি চিত্র জুড়ে চোখ ও চোখের জলের বিচিত্র ফর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। চিত্রের পুরোভূমিতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলের প্রতীকী-বিন্যাস আছে। তারই ডানপাশে আছে বাড়িঘরের প্রতীকী উদ্ভাসন, যা মেডিক্যাল কলেজের ভবন ও গেটকে মনে করিয়ে দেয়, যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল একুশের শহিদেরা। চিত্রের সাদা-কালো বিন্যাস, মুখের অভিব্যক্তিতে বিষাদের ব্যঞ্জনা, অশ্র“পাত প্রভৃতির মাধ্যমে একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সকাতর বিক্ষোভের রূপকেই চিত্রায়ণ করা হয়েছে। চিত্রটি উল্লম্ব প্রকৃতির, সবকিছু যেন উপর থেকে নিচের দিকে প্রবহমান, যেন ইতিহাসের এক ধারাবাহিকতা ও চলমানতার বোধ এর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়।

এর পরের বছরই তিনি এই একই মাধ্যমের আশ্রয়ে আঁকেন ‘একাত্তরের স্মৃতি’ (১৯৮৮)। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের দুই গৌরবময় প্রান্ত Ñ বায়ান্ন ও একাত্তরকে শিল্পী এভাবে অক্ষয় করে তোলেন। এ চিত্রে শুধু চোখ আর চোখের জলের বিচিত্র ফর্ম। এ চিত্র রচনার পেছনে কাজ করেছে শিল্পীর একাত্তরের বিভীষিকাময় স্মৃতির এক গভীর তাড়না। ঢাকা শহরসহ সারা দেশ তখন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর পদভারে নিষ্ঠুরভাবে পিষ্ট। এমনই মৃত্যুর আতঙ্কতাড়িত কারফিউজর্জর এক দিনে স্বামীবাগে ঘটে পাক- বাহিনীর পদার্পণ। পাকসেনারা একটির পর একটি বাড়িতে সার্চ করতে করতে এগিয়ে এসে শিল্পীর বাড়ি থেকে একটি বাড়ি আগে থেমে যায়। শিল্পী সস্ত্রীক তাঁর বাড়ির জানালার খড়খড়ি সামান্য ফাঁক করে তাকিয়ে দেখেন জল্লাদ বাহিনীর এই অভিযান। ছবিতে আছে ঘরের ভেতরকার সীমাবদ্ধ পরিসরের আবহ, আছে শঙ্কিত ভয়ার্ত চোখের চাহনি।

‘একাত্তরের স্মৃতি’ চিত্রটির রয়েছে দুটি ভাষ্য। এর প্রথমটির পটভূমিতে কোনো রং বা রঙের আবহ নেই। ছবির পশ্চাদ্ভূমিতে দুই চোখ ও মাথার আদল। ঘরের ভেতরে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা হচ্ছে বাইরের পৃথিবীকে। জানালা দেওয়া হয় নি, কিন্তু দেখার এই বোধটি স্পষ্ট। কোথাও কোনো গতি নেই। সবকিছু যেন স্থির হয়ে আছে। যেখান থেকে দেখা হচ্ছে কিংবা যে দিকটি দেখা হচ্ছে সবদিকেই যেন কাল স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখের আতঙ্কই যেন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। সেই শঙ্কাগ্রস্ত চোখ থেকে ঝরছে শুধু অশ্র“বিন্দু। চিত্রের সর্বত্র এই ছোটবড়ো অশ্র“বিন্দুর প্রবাহ। চিত্রের এই ভাষ্যে শিল্পী তৃপ্ত না-হয়ে তিনি ধাতবপাতে আরো কাজ করেন। ফলে রেখার সংখ্যা ও বৈচিত্র্য যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে চোখ ও অশ্র“বিন্দুর পরিমাণ। কোথাও রেখা হয়ে ওঠে আরো গাঢ় ও গভীর। উল্লম্ব আকৃতির এই চিত্রের দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়া হয় একটি আলোর প্রবাহ। এর দ্বিবিধ তাৎপর্য লক্ষণীয়। প্রথমত, চোখের নানা মোটিফ চিত্রে যে ইলাস্ট্রেশনের ভাব সৃষ্টি করেছে এই আলোর প্রবাহে তা অনেকটা কমে গেছে। এর প্রয়োজনও ছিল। কেননা ইলাস্ট্রেটিভ হওয়ার ফলে এর চিত্রগুণ হ্রাস পেয়েছিল। সুতরাং বিরচনের স্বার্থে এই আলোর প্রবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিতীয়ত, চেতনার দিক থেকে এই আলো হয়ে উঠেছে আশা ও স্বপ্নের প্রতীক। যে আতঙ্কগ্রস্ত চোখ চারদিকে ছড়িয়ে গিয়ে অশ্র“র ধারার বিষাদকে আরো তীব্র ও ঘন করে তুলেছে সেক্ষেত্রে এই আলোকধারা নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক হিসেবে কাজ করে চিত্রে সুখ-দুঃখের ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। এই মৃত্যুতাড়িত বন্দি-শিবিরের রুদ্ধাবস্থাই যে চূড়ান্ত নয়, এই অন্ধকার রাত্রিরও রয়েছে অবশ্যম্ভাবী অবসান সেটাই এই আলোর ইঙ্গিতময় অর্থ। এ চিত্রের পটভূমিতে পিঙ্গলাভ (ব্রাউনিশ) রং ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পী আলোর প্রাধান্যকেযেমন ভেঙেছেন তেমনি একই সঙ্গে কালো রংটিকে আরো জোরালো করে তুলেছেন। ধাতবপাতের ওপর কালোর মধ্যেই ঈষৎ বাদামি রং লাগিয়ে ছাপ নেওয়া হয়েছে। রং ব্যবহারেও শিল্পী এখানে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রিন্টে রঙের যে আবেদনটি পেতে চান তা স্বচ্ছ রং ব্যবহার করলে পাবেন না বলেই অনচ্ছতার দ্বারস্থ হয়েছেন এক্ষেত্রে। ব্যবহার করেছেন বান্র্ট্ আমবার। এভাবে সার্বিক সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ‘একাত্তরের স্মৃতি’র চূড়ান্ত রূপটি অর্জন করেছে সার্থকতা ।

তাম্রতক্ষণে সম্পন্ন শিল্পীর সর্বশেষ কাজটিও একাত্তরের স্মৃতিতে ভাস্বর। নাম : ‘একাত্তরের স্মরণে’ (২০০২)। এ চিত্রটিরও রয়েছে তিনটি ভাষ্য। তবে নতুন কোনো রেখার সংযোজন ঘটে নি এসব ভাষ্যে। কেবল আলো ও রঙের কিছু তারতম্যের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তিনটি ভাষ্য। প্রথম চিত্রটিতে রং হয়ে গেছে কিছুটা হালকা, আবার দ্বিতীয়টিতে তা কিছুটা গাঢ় হয়েছে এবং চূড়ান্ত ভাষ্যে এসে রঙের গাঢ়ত্ব কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে রেখাগুলোর প্রাধান্য বজায় থাকে। আলোর সঙ্গে পটভূমিতে ব্যবহৃত হয়েছে সবুজাভ রং। এই চিত্রটির কেন্দ্রভূমিতে আছে শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। চূড়ান্ত ভাষ্যে শুধু আত্মপ্রতিকৃতির অংশটুকুতেই আলো ফেলা হয়েছে। কিন্তু এর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষ্যে আলোর পরিধি ছিল আরো বি¯তৃত। এই আত্মপ্রতিকৃতি অঙ্কন শিল্পীর সচেতন পরিকল্পনার অংশ নয়। একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থনের প্রক্রিয়ায় অবচেতন মন থেকে উঠে এসেছে নিজের মুখাবয়ব। আসলে একাত্তরের ঘটনা তো শুধু একাত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। মনের মধ্যে রয়ে গেছে এর এক স্থায়ী ছাপ। আমাদের চিন্তাকাশে অহরহই ঘটছে তার নানা উদ্ভাসন। একে কীভাবে চতুষ্ক ফ্রেমে অভিব্যক্ত করা যায় সেটাই মূল কথা। মানবমনের এই জটিল প্রক্রিয়ায়ই রূপান্বিত হয়েছে নিজ মুখের আদল। এ যেন একান্তই ব্যক্তিগত। আবার একই সঙ্গে তা ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যাওয়ারও প্রয়াস। নিজ চোখের জলের মধ্যেই তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সমগ্র দেশের ক্রন্দন। ফলে শুধু মুখাবয়বেই আলো ফেলা হয়েছে যাতে ওখানেই নিবদ্ধ হয় দর্শকের দৃষ্টি, ওখানেই যাতে দর্শক দেখতে পায় পুরো একাত্তর জুড়ে সমগ্র দেশের মানুষের লাঞ্ছনা, পীড়ন ও মর্মযাতনার শোকচিহ্ন। যদিও এ চিত্রে চোখের মোটিফ খুব বেশি আঁকা হয় নি, তবু মুখাবয়বের বাইরের ওইসব চোখ একটি বার্তাই বহন করে, তা হল : চোখ থেকে অশ্র“পাতের বিষয়টিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষে। এ চিত্রে সরল রেখার প্রতিবিন্যাস হিসেবে এসেছে বক্র রেখা। উল্লম্ব আকৃতির এ চিত্রের ডান ও বাম পাশে দুটি করে সরল উল্লম্ব রেখা এবং পশ্চাদ্ভূূমিতে আরেকটি সরল রেখার উপস্থিতি চিত্রটির বিরচনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনদিকের এই রেখা যেন শিল্পীর চিন্তাশক্তিকে দান করেছে একটি নির্দিষ্ট অবয়ব বা শৃঙ্খলা। এভাবেই চিত্রটি হয়ে উঠেছে সার্থক।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।