এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট

এচিং-মাধ্যমে আগে তাম্রপাত ব্যবহৃত হত। কিন্তু তামার মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে এ-মাধ্যমে এখন দস্তা -পাতই ব্যবহৃত হয়। ইন্টাগ্লিও বা অন্তর্লীন পদ্ধতিতে কাজ করা হয় এ-মাধ্যমে। ফলে ছবিতে যে-অংশটি সাদা রাখা প্রয়োজন সে-অংশটি অক্ষত রেখে বাকি অংশে কাজ করতে হয়। প্রথমে ধাতুপাতের ওপর হার্ডগ্রাউন্ড বারনিশের প্রলেপ দিয়ে তা শুকিয়ে তার ওপর পরিকল্পনা অনুযায়ী নিডল বা সুচ দিয়ে রেখার মাধ্যমে ছবি আঁকতে হয়। আঁকা শেষ হলে ধাতুপাতকে অ্যাসিডের পাত্রে ডুবিয়ে দিলে অঙ্কিত অংশে অ্যাসিড প্রবেশ করে ধাতবপাতে গর্ত বা ক্ষত সৃষ্টি করে। রেখাগুলো কত সূক্ষ্ম বা গভীর হবে তা ধাতুপাতকে অ্যাসিডে কম/বেশি খাওয়ানোর ওপর নির্ভর করে। যেমন, সূক্ষ্ম রেখাগুলোকে স্টপআউট দিয়ে ঢেকে বাকি রেখাগুলোকে অধিকতর সময় অ্যাসিডে খাইয়ে মোটা করতে হয়। তাছাড়া চিত্রে কোনো টেক্সচার ব্যবহার করতে হলে সফটগ্রাউন্ড বারনিশের প্রলেপ দিয়ে তার ওপর টেক্সচারের উপযোগী বস্তুর ছাপ দিয়ে পাতটিকে অ্যাসিডে খাওয়াতে হয়। পরে পাতটিকে অ্যাসিড থেকে তুলে বারনিশ পরিষ্কার করে কিনারগুলো ঘষে ছাপ নেওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়।

কলকাতায় থাকাকালেই সফিউদ্দীন আহমেদ এচিং-মাধ্যমের অনুশীলন শুরু করেন। এই চর্চা নির্বিঘ্ন করার সুবিধার্থেই কেনেন একটি এচিং মেশিন। ১৯৪৭এ ঢাকায় চলে এলেও মেশিনটি রয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। ১৯৫৪ সালে সেটি আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়। মেশিনটি আনার পর ১৯৫৫ সালে তিনি বন্যাক্রান্ত ঢাকা নিয়ে দুটি চিত্র রচনা করেন। একটি উপরে আলোচিত ‘নৌকায় শূন্য কলস’ শীর্ষক অ্যাকুয়াটিন্ট চিত্র। অন্যটি এচিং মাধ্যমে সম্পাদিত : ‘বন্যাপ্লাবিত ঢাকা’। কাজটি ছোট। স্বামীবাগে তাঁর বসবাসের এলাকায় চারদিকটা প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। গাছের নিচের অংশ পানিতে ডুবে আছে। এটাই চিত্রের বিষয়। প্লাবিত বাড়িঘর গাছের মধ্য দিয়ে নৌকায় কলসি নিয়ে একজনের যাতায়াতের চিত্র এতে ধারণ করা হয়েছে।

কলকাতা কিংবা ঢাকায় শিল্পীর এচিং মাধ্যমের চর্চাটি আকাক্সিক্ষত গতি লাভ করতে পারে নি, যতক্ষণ-না তিনি এ-বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন যান।

১৯৫৬-৫৯ কালপর্বে সফিউদ্দীন আহমেদ লন্ডনে গিয়ে এচিং ও এনগ্রেভিং (মেটাল) মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করলে তাঁর চিত্রচর্চায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। এক. সাদাকালোর পরিবর্তে তাঁর ছাপচিত্র হয়ে ওঠে রঙিন। দুই. দৃশ্যবস্তুকে হুবহু চিত্রায়িত করার পরিবর্তে তাঁর চিত্রতলে ঘটে অবয়বের ব্যাপক ভাঙচুর, এবং চিত্রতল ভরে ওঠে রূপকল্পের সূক্ষ্ম প্রতীকধর্মিতায়। আরেকটি কথাও এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ১৯৫৬-পরবর্তী তাঁর কাজে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যম পরস্পর এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, এর পর এই দুই রীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে আর কম ছবিই তিনি এঁকেছেন। ফলে এ অধ্যায়ের এরকম নামকরণই আমরা যথার্থ মনে করেছি। ১৯৫৬-পরবর্তী কাজে আমরা লক্ষ করব, একই চিত্রে তিনি এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টের সঙ্গে সফটগ্রাউন্ড, লিফটগ্রাউন্ড, ডিপ-এচ প্রভৃতি নানা বৈশিষ্ট্যকে যুক্ত করেছেন।

লন্ডনে যাওয়ার পরপরই তিনি এচিং মাধ্যমে প্রথম যে চিত্রটি আঁকেন সেটির নাম : ‘মাছ ধরার সময়-১’ (১৯৫৭)। চিত্রটিতে এচিং ছাড়া অ্যাকুয়াটিন্ট ও সফটগ্রাউন্ড মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সফটগ্রাউন্ড প্রক্রিয়ায় চিত্রতলের বিভিন্ন অংশে সৃষ্টি করা হয়েছে জালের আবহ। এজন্যে ব্যবহৃত হয়েছে মেয়েদের মোজা, মশারি প্রভৃতি। লন্ডনের এই প্রথম চিত্রেই আমরা লক্ষ করি তাঁর শিল্পীসত্তার মৌলিক পরিবর্তনের দিকচিহ্ন : ছাপচিত্রে রঙের সমাবেশ। সে-সময়ে লন্ডনে এচিং মাধ্যমে বিভিন্ন রং ব্যবহারের প্রচলন থাকায় সফিউদ্দীনও এ-ব্যাপাওে আগ্রহী হন। এর টেকনিকটি তাঁর আগেই জানা ছিল বলে এতে অভ্যস্ত হতে সমস্যা হয় নি। সফটগ্রাউন্ড প্রক্রিয়ায় চিত্রতলে এসেছে হলুদ রং। অ্যাকুয়াটিন্টের ফলে এসেছে কালো। আর সূক্ষ্ম চিকন রেখাগুলো সৃষ্টি হয়েছে এচিং মাধ্যমে। জালে হলুদ রং ব্যবহৃত হয়েছে কালোর বিপরীতে চিত্রতলের কিছু অংশের রংকে উজ্জ্বল করার অভিপ্রায়ে। ওইসব অংশও অনুজ্জ্বল হলে চিত্রের সাদা অংশটি প্রকট হয়ে উঠত। কিন্তু কালো ও হলুদের পরিপ্রেক্ষিতে চিত্রতলে বর্তমানে সাদা যেভাবে আছে তাতে চিত্রটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। চিত্রতলের বাঁয়ের একটি অংশে প্রতীকীমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে পানির আবহ। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মাছ ধরার একটি সুপরিচিত দৃশ্য এই চিত্রের বিষয়। একটি বিশাল জালকে ত্রিভুজাকৃতির বাঁশের ফ্রেমে বেঁধে পানিতে পেতে রাখা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তরে শারীরিক শক্তি প্রয়োগে পা দিয়ে চেপে ধরে জাল উঠিয়ে মাছ নৌকায় ফেলা হয়। এক ব্যক্তিই এ কাজটি করেন। এ চিত্রেও স্বাভাবিকভাবে জালকে বড়ো করে তোলা হয়েছে এবং সেই তুলনায় মানুষটিকে আঁকা হয়েছে অত্যন্ত ছোট করে। প্রকৃতির পটভূমিতে মানুষ কত ছোট আবার একই সঙ্গে সে কত শক্তিমান এই বোধকেও এর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে চিত্রটিতে এসেছে একটা প্রচণ্ড গতি ও সংকর্ষ। এই গতিকে ধারণ করার জন্যই অবয়বের ভঙ্গিসহ রেখাগুলো দারুণভাবে বেঁকে গেছে।

এই চিত্রটি তিনটি স্তর অতিক্রম করে চূড়ান্ত হয়েছে। এই তিন স্তরের মধ্যে পার্থক্য হল শুধু রঙের। প্রথম স্তরটি শুধু সাদা-কালো। দ্বিতীয় স্তরে ঈষৎ পিঙ্গল রং ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এই রং ব্যবহার করে শিল্পীর মনে হয়েছে কালোর বিপরীতে এ রংটি উত্তমরূপে পরিস্ফুটিত হয় নি। ফলে তিনি তৃতীয় স্তরে পিঙ্গলাভ রঙের পরিবর্তে হলুদাভ রং ব্যবহার করে তৃপ্তি বোধ করেন। কেননা আলোর বিপরীতে হলুদাভ রংটি যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে তেমনি এর ফলে উভয় রংই হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ।

এর পরে লন্ডনে তাঁর প্রথম পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য চিত্র হল সূর্যমুখী ফুল নিয়ে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সম্পাদিত ‘জড়জীবন’ (১৯৫৭)। এই চিত্রও তাঁর শিল্পীসত্তার আরেকটি মৌলিক পরিবর্তনের দিকচিহ্ন ধারণ করে আছে। তা হল : অবয়বের অবিকল রূপের প্রস্থান। এই চিত্রে সূর্যমুখীর প্রকৃত রূপাবয়ব সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এবং একই সঙ্গে এর ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ভেঙে দিয়ে ফ্ল্যাট সারফেসের দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একে ধারণ করা হয়েছে। মোটেই সহজসাধ্য নয় এটি। এই চিত্রের বিরচনের দিকটিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। টেবিলের ওপর কোনো পাত্রে রাখা দুটো সূর্যমুখীর চিত্র এটি। অথচ টেবিলে পাত্র রাখার পরিপ্রেক্ষিতটিও পুরোপুরিভাবে ভেঙে দিয়ে টেবিলটাকে পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী না-সাজিয়ে উল্লম্বভাবে স্থাপন করে ফুল রাখা হয়েছে তার গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে। অর্থাৎ এখানে এমন এক ধরনের বিরচনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে যেখানে পরিপ্রেক্ষিতকে পুরোপুরিভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে। ফুল দুটো বাস্তবে চোখের দৃষ্টিতে একই লেভেলে ছিল কিন্তু চিত্রে তাকে এমনভাবে ধারণ করা হয়েছে যাতে মনে হবে, কাগজ কেটে এদের পৃথক করা হয়েছে। ফ্ল্যাট সারফেসে পরিপ্রেক্ষিত মুছে দিয়ে এভাবে কাজ করা শুরু হল এ ছবির মধ্য দিয়ে। এটা এক ধরনের বিরচনের খেলাও। সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পযাত্রায় এই চিত্রটি বাঁক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হয়ে আছে। লক্ষণীয় এ চিত্রের গতির দিকটাও। টেবিল, পাত্র ও ফুলের ভাঙচুরকৃত আকারের মধ্য দিয়ে চিত্রে এই গতি সঞ্চারিত হয়েছে। ফুলের গতি যখন ডান দিকে তখন অন্য গড়নের গতি বাঁদিকে। লন্ডনে এটাই শিল্পীর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

১৯৫৮ সালে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সম্পাদিত তাঁর তিনটি কাজের মধ্যে একটি ‘বন্যা-১’, দ্বিতীয়টি ‘বন্যাপ্লাবিত গ্রাম’, এবং তৃতীয়টি ‘ঝড়’ বা ‘এক্সপোজ দি স্টর্ম’। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের বন্যা শিল্পী সফিউদ্দীনের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। কেননা কলকাতার জীবনে তিনি এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কখনো হন নি। নিজ বাড়ির চারদিক প্লাবিত, নৌকা ছাড়া বের হওয়ার উপায় নেই, যেটুকু নিরাপত্তা আছে তাও যে কোনো সময় বিঘিœত হতে পারে। নিরাপত্তাহীনতার এই গভীর ক্ষতচিহ্ন লন্ডনে গিয়েও যে তাঁকে তাড়া করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানে আঁকা তাঁর চিত্রের বিষয়ের দিকে তাকালে। বারবার বন্যা এসে ভিড় করে তাঁর চেতনারাজ্যে।

‘বন্যা-১’ শীর্ষক চিত্রটিতে বন্যার এক বিমূর্ত রূপায়ণ ঘটেছে। তবে চিত্রের সব রূপকল্প পানিতে ভাসমান এমন একটি রূপ সৃষ্টির মাধ্যমে বন্যার আবহকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে পরিচিত সব ফর্মকে। গাছ, গাছের পাতা, পানি ও পানির ফোঁটার নানা পরিচিত-অপরিচিত রূপকল্পে ভরাট হয়ে আছে চিত্রতল। গাছের পাতা পানিতে পড়লে পানির মধ্যে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে যে বৃত্ত রচিত হয় তারই একটি রূপ অঙ্কনের চেষ্টা আমরা দেখি চিত্রতলের পুরোভূমির বাঁ কোণে। স্থূল রেখার ব্যবহারেও চিত্রটি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালের ছবিতে শিল্পী রেখার রূপকে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক করে তুলেছেন, কিন্তু ওই ধারণাটির সূচনা এ চিত্রেই লক্ষণীয়। এসব রেখা সৃষ্টির জন্য ডিপএচ-পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পী।

‘বন্যাপ্লাবিত গ্রাম’ শীর্ষক চিত্রটিতে পাখির চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে বন্যাক্রান্ত গ্রামের ছবি, যেখানে সবকিছু প্লাবিত ও নিমজ্জিত, উপর থেকে দেখা টিনের চালের রেখাগুলো পরিস্ফুট করা হয়েছে। এ চিত্রে আরো আছে নিমজ্জিত গাছের রূপকল্প। এচিংয়ের সঙ্গে লিফটগ্রাউন্ড ও অ্যাকুয়াটিন্ট পদ্ধতিও ব্যবহৃত হয়েছে। অ্যাকুয়াটিন্টের গুঁড়ো ব্যবহার করে সাদা রেখাগুলোকে কালো করা হয়েছে। একাধিক প্লেট নয়, একটিমাত্র প্লেট ব্যবহার করে সম্পাদিত হয়েছে এ চিত্র। একটি প্লেটে সম্পূর্ণ কাজটি করে তার ওপরই বিভিন্ন রং লাগিয়ে প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে। রং লাগানো হয়েছে ড্যাবার দিয়ে । একটি প্লেটে কত ধরনের রং ব্যবহার করা যায় তার একটি উত্তম দৃষ্টান্ত এটি। এ চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে লাল, হলুদ, নীল, কালোর ওপরে হলুদ প্রভৃতি রং। এ চিত্রের ক্ষেত্রে প্রিন্ট নেওয়ার কৌশলটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘ঝড়’ বা ‘এক্সপোজ দি স্টর্ম’ চিত্রটিতেও লিফটগ্রাউণ্ড প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এ চিত্রের মূল বিষয় গতি। চিত্রটিতে ব্যবহৃত হয়েছে গাছ, গাছের গুঁড়ি প্রভৃতির অপরিচিত রূপকল্প। ঝড়ের প্রবল বায়ুতাড়না প্রকৃতিজগতে যে প্রলয় সাধন করে তার রূপকেই শিল্পী এ চিত্রে ধারণ করতে চেয়েছেন। এ কালপর্বে তাঁর চিত্র থেকে পরিচিত রূপকল্প যে বিদায় নিয়েছে তার উদাহরণ হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এ চিত্রে অ্যাকুয়াটিন্টের দানাদার রূপ যেমন আছে তেমনি ওই রূপের মধ্যেই ঘটেছে নানা বর্ণবিভার বৈচিত্র্য। এ চিত্রটিরও রয়েছে কয়েকটি ভাষ্য। এর প্রথম স্তরটি সাদা-কালো, সেটির কোনো ছবি নেই। দ্বিতীয় স্তরে কালো ছাড়া হলুদ রং ব্যবহারের ফলে কিছু ফর্ম হারিয়ে যায়। যেহেতু গাছকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে নানা ফর্ম বের করে চিত্রটি সম্পন্ন করা হয়েছে সেহেতু ফর্ম কমে গেলে চিত্রটির সার্থকতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে-কারণে শিল্পী তৃতীয় স্তরে গিয়ে এর চূড়ান্ত রূপ দেন। এই স্তরে হলুদ রঙের স্থলে ব্যবহৃত হয়েছে কোথাও সবুজ, কোথাও সাদা রং। এর ফলে সবগুলো রং যেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে পেরেছে, তেমনি রঙের বৈচিত্র্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। চূড়ান্ত পর্বে সাদা রং ব্যবহারের ফলে ফর্ম বেড়ে গেছে। বেশি ফর্ম সৃষ্টি হলে ছবি অনেক সময় ভিড়াক্রান্ত হয়ে পড়ে বা ছবিতে এক ধরনের গাদাগাদি ভাব চলে আসে। এটা পরিহার করার জন্য রঙের তারতম্য সৃষ্টি করে নানা গভীরতা নিয়ে এলে চিত্র হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ। এ চিত্রটির ক্ষেত্রে শিল্পী এই শেষোক্ত পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন।

লন্ডনে ডিপ্লোমা পাসের পর ১৯৫৯ সালে তিনি এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে রচনা করেন তিনটি উল্লেখযোগ্য চিত্র। এগুলির নাম : ‘নেমে যাওয়া বান’, ‘বন্যা-২’ ও ‘সেতু পারাপার’। এই তিনটি চিত্রকর্মেই রয়েছে শিল্পীর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ‘নেমে যাওয়া বান’ চিত্রটিতে প্রাধান্য অর্জন করেছে একটি বৃক্ষের রূপকল্প । বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে এই আবহটি চিত্রে বর্তমান। চিত্রতলের পুরোভূমির বাঁ দিকে পানি ও নৌকা আর পশ্চাদ্ভূমিতে ঘরের চালার রূপকল্প। এই চিত্রে রেখার মধ্যে একটা গতিশীলতা আছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে পানি স্থির। কেননা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় পানির মধ্যে স্রোত কিংবা গতি থাকে না। পানি ধীরে ধীরে নীরবে হ্রাস পেতে থাকে। এই চিত্র রচনায় এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টের পাশাপাশি লিফটগ্রাউন্ড মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। পদ্ধতিটি এরকম : প্রথমে সলিউশন দিয়ে ধাতুপাতে ড্রইং করার পর স্টপআউট সলিউশন দিয়ে বাকি অংশ ঢেকে দেওয়া হয়। এই সলিউশন শুকিয়ে যাওয়ার পর প্লেটটি সিঙ্কের পানিতে ডোবানো হলে ড্রইং অংশের সলিউশন উঠে গিয়ে সাদা প্লেট বেরিয়ে পড়ে। এর পরে অ্যাকুয়াটিন্ট বাক্সে প্লেটটিকে ঢুকিয়ে তাতে রেজিনের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাপ দিয়ে পরে প্লেটটিকে এসিডে খাইয়ে দানাদার করা হয়। অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে চিত্রতলে হালকা থেকে গাঢ় কালো রঙের সমাহার ঘটানো হয়েছে, অন্যদিকে প্লেটের অংশবিশেষ স্টপআউট দিয়ে ঢেকে পরবর্তী স্তরে হালকা টোনের ব্যবহার করা হয়। বর্ণবৈভিন্ন্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে এরপর প্লেটটিকে অ্যাসিডে খাওয়ানোর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ফলে প্রায় দুমাস লাগে ছবিটি সম্পন্ন করতে। সবশেষে আয়োজন করা হয় রং দেওয়ার। পানির রং গাঢ় নীল। গাছের কাণ্ড কালো; কিন্তু পাতাসহ উপরের অংশে লাল রং ব্যবহারের কারণ, গাছটির নিচের অংশ পানিতে নিমজ্জিত থাকায় মরে যাওয়ার ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। কালো রঙের ছাপ নেওয়া হয় সবশেষে। মাধ্যমের উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিত্রটি রচিত হওয়ায় তা বিশিষ্টতা অর্জন করেছে।

‘বন্যা-২’ শীর্ষক এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট-চিত্রটিতেও ব্যবহৃত হয়েছে বৃক্ষের রূপকল্প। প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে এসেছে এই গাছ। কারণ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি জনজীবন সবকিছু। নিমজ্জিত বৃক্ষ এই ক্ষয়ক্ষতির মূর্ত প্রতীক। গঠনবিন্যাসের দিক থেকে আমগাছের এক রূপ, কদম গাছের আরেক রূপ। এখানে রয়েছে এই দুই রূপের একটি সমন্বয়। চিত্রটিতে সবকিছুর মধ্যে রয়েছে একটা গতি। এই গতির মধ্যে যেন বাক্সময় হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের প্রবণতা। এই প্রতিবাদ সরব নয় নীরব। কেননা প্রতিবাদটি অভিব্যক্ত হয়েছে বৃক্ষের গঠনগত গতির রূপকে। নিমজ্জিত অবস্থার বিরুদ্ধে যেন এই প্রতিবাদ। অসাধারণ নকশা-গুণসম্পন্ন এই চিত্রটিতে রয়েছে মাধ্যমগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূক্ষ্ম পরিচয়। ‘নেমে যাওয়া বান’ শীর্ষক চিত্রটির মতোই পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এখানেও শিল্পী যাত্রা করায় চিত্রটি সার্থক হতে পেরেছে। উভয় চিত্রে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ ও তার আলোকে যেভাবে বের করা হয়েছে তাতে শিল্পীর বাস্তববোধ ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সম্পাদিত সফিউদ্দীন আহমেদের সবচেয়ে সার্থক চিত্রটির নাম ‘সেতু পারাপার’ (১৯৫৯)। সাদা-কালো এই চিত্রটিতে শিল্পী অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের গুণগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন। অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমটি তখনই গুণগতভাবে সমৃদ্ধ হয় যখন রেজিনের গুঁড়োসহ প্লেটকে অ্যাসিডে খাওয়ানোর সময় গুঁড়োযুক্ত শীর্ষদেশকে রক্ষা করে অর্থাৎ শীর্ষদেশকে সাদা রেখে প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করা যায়। মাথাকে বাঁচিয়ে খাওয়াতে পারলেই অ্যাকুয়াটিন্টের দানাদার ভাবটি ভালোভাবে বজায় থাকে। এ চিত্রটিতে নানা মাত্রার দানাদার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে অ্যাসিডে খাইয়ে কোথাও হালকা কোথাও গাঢ় করে তোলা হয়েছে। চিত্রে একটি সেতু দৃশ্যমান, যার নিচে পানি এবং ডানপাশে ঘরবাড়ি। সেতু পার হয়ে লোকজন চালের দোকানে যাচ্ছে। পুরোভূমির পানির অংশে তীব্র গতিময়তা। পানির রঙেও কোথাও ঔজ্জ্বল্য কোথাও অনুজ্জ্বলতা। পানির একটি অংশে তীব্র আলো পড়ায় সেই অংশটি একেবারে সাদা রাখা হয়েছে। পানির ওপর আলোর খেলা ও পানির ভেতরকার গতি এই দুইকে চিত্রিত করার জন্য পানির রঙে যে তারতম্য আনা হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমটিকে যেভাবে দক্ষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে শিল্পীর নৈপুণ্যের পরিচয়টি স্পষ্ট। বাঁদিকের পুরোভূমিতে নৌকার ফর্ম থেকে উঠে-আসা একটি রেখা চিত্রতলের ডানদিকের পশ্চাদ্ভূমিতে গিয়ে আবার বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। এই রেখার বিপরীতে আরেকটি রেখা এসেছে পশ্চাদ্ভূমি থেকে। এভাবে তা চিত্রের ভারসাম্যকে ধরে রেখেছে। পশ্চাদ্ভূমির রেখাটি না-দেওয়া হলে চিত্রটি একদিকে হেলে পড়ত। চিত্রতলে প্রথমেই পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় আলোকিত পানি ও মানুষগুলোর ওপর। এখানে পানির ঘূর্ণনে রেখার মধ্যে যে গতিশীলতা আছে তাকে ভেঙে দেওয়ার জন্য নৌকাটি বসানো হয়েছে। এ চিত্রে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্টের সঙ্গে লিফটগ্রাউন্ড প্রক্রিয়ারও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। লিফটগ্রাউন্ডের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে মোটা রেখাগুলো। স্থূল এসব রেখার বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে সূক্ষ্ম রেখাও। পশ্চাদ্ভূমি থেকে সাদা রং নেমে এসে কালোর উত্থানকে থামিয়ে দিয়েছে। চিত্রতলের মধ্যভূমিতে ও কিছুটা পশ্চাদ্ভূমিতে সৃষ্টি করা হয়েছে দুটি নৌকার গড়ন। এসব গড়নের বিপরীতে আরো নানা গড়ন সৃষ্টি করা হয়েছে ভারসাম্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে। চিত্রটির বিরচনগত বৈশিষ্ট্যটিও তাৎপর্যপূর্ণ।

লন্ডন থেকে ফেরার পর এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের কাজে তিনি নিজেকে আরো কীভাবে অতিক্রম করা যায় সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রত হন। ১৯৬২ সালে জাপানের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট তাদের ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল এক্সিবিশনের জন্য সফিউদ্দীন আহমেদসহ পাকিস্তানের তিনজন শিল্পীকে বাছাই করে। ওই প্রদর্শনীর জন্য সফিউদ্দীন আহমেদ এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে ‘মাছ ধরার সময়-২ ও ৩’ শীর্ষক দুটি চিত্র রচনা করেন।

এ দুটি চিত্র রচনায় শিল্পী একটি নতুন বিষয়ের ওপর জোর দেন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি সরু রেখা নিয়ে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেন। এবারে ঢাকায় তিনি রেখাকে মোটা বা স্থূল করার দিকে মনোযোগী হন। আগে তিনি রেখার ভেতরটা দানাদার করার চেষ্টা করেন নি। তাতে রেখার ভেতরে চোখ আটকে রাখা যেত না। ‘মাছ ধরার সময়-২’ শীর্ষক চিত্রে তিনি চাইলেন রেখার ভেতরে চোখটাকে ধরে রেখে ধীরে ধীরে এগোতে। ফলে তিনি অ্যাকুয়াটিন্ট প্রক্রিয়ায় রেখার ভেতরটা দানাদার করার চেষ্টা করলেন। তাতে রেখাগুলো যেমন স্থূল হল তেমনি তা ধারণ করল ইমপ্যাস্টোর (রঙের ঘন প্রলেপ) রূপ। একই সঙ্গে তা হয়ে উঠল ইমবস গুণসম্পন্ন অর্থাৎ চিত্রতল থেকে রেখা উঁচু হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ চিত্রে পানি ও জাল যেমন আছে তেমনি আছে নৌকার গলুইসহ নানা গড়ন। ইমবস কোয়ালিটির ফলে চিত্রতলে কয়েকটি পরত সৃষ্টি হয়েছে, যাতে আমরা জালের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি। গাঢ় হলুদ, গাঢ় নীল, সাদা ও কালোর সংমিশ্রণে এবং সূক্ষ্ম ও স্থূল রেখার যৌথতায় চিত্রটি নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। ‘মাছ ধরার সময়-৩’ শীর্ষক চিত্রটিতেও স্থূল রেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে। পানি, জাল, মাছ ও নৌকার নানা গড়ন এ চিত্রেরও উপজীব্য। এ চিত্রে পানি নীলের পরিবর্তে হলুদ ও সাদা রং ধারণ করেছে। এটি শিল্পীর ইচ্ছাকৃত। প্রতীকী ব্যঞ্জনা সৃষ্টির অভিপ্রায়ে এটি করা হয়েছে। এ চিত্রে সৃষ্টি করা হয়েছে লাল রঙের তিনটি ফর্ম। এসব ফর্মের মাধ্যমে জালের ভেতরে মাছ, মাছের চোখের ভেতরে মাছ কিংবা ত্রিকোণাকৃতি ফর্মের ভেতরে মাছকে প্রতীকীভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া সফটগ্রাউন্ড প্রক্রিয়ায় মশারি বা মোজার ছাপ দিয়ে জালের আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে।

১৯৬৪ সালে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে তিনি অঙ্কন করেন দুটি চিত্র : ‘নীল জল’ ও ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’। এসব চিত্রের পটভূমি ১৯৫৪-৫৫র বন্যা। যখন তিনি ঢাকা শহরে বসবাস করেও বন্যাক্রান্ত, বন্যার পানিতে বন্দী। এ নতুন অভিজ্ঞতা কলকাতার সন্তান সফিউদ্দীন আহমেদের স্মৃতিতে রেখে যায় এক স্থায়ী ছাপ। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় ঘরের জানালায় বসে কিংবা ভাড়া-করা নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে পানির মধ্যে দেখেছেন ছোট-বড়ো মাছের চলাচল, পানির ওপর ফড়িংয়ের লাফিয়ে চলা প্রভৃতি। দেখেছেন পানির তরঙ্গ। এবং এসবের মধ্য দিয়ে পানির এক ধরনের ড্রইং শিল্পীর মনে ঘুরপাক খেয়েছে, আবর্তিত হয়েছে সরু ও মোটা নানা ধরনের রেখা।

‘নীল জল’ চিত্রটিতে লক্ষণীয় সূক্ষ্ম ও স্থূল রেখার এক অপূর্ব সমন্বয়। সরু রেখাগুলো যেমন হয়ে উঠেছে জালের প্রতীক তেমনি তা মোটা রেখাগুলোকে বেঁধে রেখে চিত্রতলে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। চিত্রতলের বাঁ পাশে কিংবা পুরোভূমিতে যে দুটো অংশকে চোখের রূপকল্প বলে মনে হয় সেগুলো আসলে পানির এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ওইসব অংশে ব্যবহৃত হয়েছে নানা টেক্সচার । সূক্ষ্ম সরু রেখাগুলোই যে শুধু এচিং মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, মোটা স্থূল রেখা সৃষ্টির মূলেও রয়েছে ওই মাধ্যমেরই কৃতিত্ব। এই চিত্রটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এখানে রং ব্যবহারের নৈপুণ্যের ফলে চিত্রটিতে নানা পরতসহ গভীরতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। নীল, সাদা ও কালোর পাশাপাশি বিন্যাসে কালো উঠে এসেছে সবার উপরে, সাদা চলে গেছে তার নিচে, এবং সবচেয়ে গভীরে চলে গেছে নীল। ফলে মোটা রেখাসহ ফর্মগুলো যেন চিত্রতল থেকে উপরে উঠে এসেছে ইমবস পদ্ধতির প্রয়োগে যেমনটা ঘটে। এ চিত্রটিরও রয়েছে তিনটি ভাষ্য। রং ব্যবহারের ভিন্নতা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এসব ভাষ্য। প্রথম স্তরে সাদা ও কালো রং ব্যবহার করে শিল্পী অনুভব করেন, আকাক্সিক্ষত ফল তিনি পান নি। পরে তিনি মত পাল্টে সমগ্র পটভূমিতে হলুদ রং ব্যবহার করেন, ডটগুলোকে সাদা রাখেন এবং বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ব্যবহার করেন সবুজ রং। এভাবে সৃষ্টি হয় চিত্রটির দ্বিতীয় ভাষ্য। কিন্তু এটিও শিল্পীর মনঃপুত হয় না। তিনি আবারও মত পাল্টে রং ব্যবহারের সমগ্র পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে এর চূড়ান্ত ভাষ্যটি রচনা করেন। এই চূড়ান্ত পর্বে হলুদের জায়গাগুলোর কিছু অংশে নীল ও কিছু অংশে সাদা এবং সবুজের স্থলে লাল ব্যবহার করায় চিত্রটি ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। শেষে সাদা অঞ্চলগুলোতে কালো ব্যবহার করায় ছবিটি হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ (হেভি)। কালোর সঙ্গে লালের সমন্বয়ে বেড়ে যায় দুটো রংয়েরই ঔজ্জ্বল্য। ধাতবপাতের অমসৃণ অংশে ব্যবহৃত হয়েছে কালো এবং মসৃণ অংশগুলোতে নীল, হলুদ ও সাদা। এ চিত্রের চূড়ান্ত ভাষ্যটির পাশে অন্য দুটিকে রাখলে উপলব্ধি করা যায়, শিল্পীর রং ব্যবহারের পরিকল্পনায় বারবার পরিবর্তন সাধনের ফলে ছবিটি কত উন্নত ও সার্থক হতে পেরেছে।

‘বিক্ষুব্ধ মাছ’ শীর্ষক চিত্রটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জালে আবদ্ধ মাছটির চোখে যে বিক্ষোভের আগুন তা তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাশাসকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শৃঙ্খলিত মানুষের অন্তঃক্ষোভেরই প্রতীকী প্রকাশ। স্মরণীয় যে, মাছ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং জাতীয় জীবনের মর্মবেদনাকে রূপকায়িত করার জন্য মাছের এই ব্যবহার চিত্রটিকে অন্যভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। এ চিত্রের বিভিন্ন ফর্ম ব্যবহারে শিল্পীর নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রয়েছে। মাছের ঠিক নিচের অংশের ফর্মটা এমনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যাতে মনে হয় তা মাছটাকে উপরের দিকে তুলে দিচ্ছে। নিচের ফর্মে জালের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে সাদা রঙের মাধ্যমে। মাছ যেহেতু ধরা হয়েছে জাল দিয়ে সেহেতু জালটাকে নানাভাবে বিন্যাসের চেষ্টা শিল্পী করেছেন। তাছাড়া চিত্রতলে অন্য ফর্মগুলোকে এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে যাতে মাছের ওজনটা উপলব্ধি করা যায়। পাশাপাশি মাছটির জালে-আবদ্ধ রূপটিও স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। স্থূল রেখাগুলোর ওপর অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে দানাদার ভাব সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। মোটা রেখাগুলো ইমবস পদ্ধতির মতো চিত্রতল থেকে যেন উপরে উঠে এসেছে। ‘নীল জল’-এর মতো এখানেও রং ব্যবহারের নৈপুণ্য দ্বারা নানা পরতসহ চিত্রতলে গভীরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে নীল নেই কিন্তু এখানে কালোর নিচে হলুদ, তারপর লাল এবং একেবারে নিচে সাদা রঙের বিন্যাসে এই গভীরতা এসেছে। চিত্রতলের কোনো কোনো অংশে ছোট বড়ো কিছু ফোঁটা ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে চিত্রতলের একঘেয়েমি বা মনোটনি অনেকটা দূর হয়েছে। চিত্রটিতে কালো রঙেরই যেহেতু প্রাধান্য বা কালো রংকে গুরুত্ব দিয়েই পরিকল্পিত হয়েছে চিত্রটি সেহেতু এর ঠিক বিপরীত রং হিসেবে সাদা অংশগুলোর মাধ্যমে আলো ঠিকরে পড়েছে। চিত্রতলের সাদা অংশও নিরেট সাদা থাকে নি সেখানে সৃষ্টি হয়েছে অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের দানাদার বৈশিষ্ট্য।

১৯৬৬ সালে আঁকা ‘ভাসমান জাল’ চিত্রটিতেও সরু ও মোটা রেখার সমন্বয় সৃষ্টি করা হয়েছে। আঁকা হয়েছে জালের নানা রূপ। বিরচনের স্বার্থে এ চিত্রের ফর্মগুলো ধারণ করেছে বিচিত্ররূপ। পানির তরঙ্গ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে ফর্মগুলো এমন বিকৃত হয়েছে। চিত্রতলে একটা চক্রাকার আবহ আছে। ঘুরে ঘুরে যাওয়া এক ধরনের ঘূর্ণন। ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’ শীর্ষক চিত্রটির চেয়ে এই চিত্রে গতি অনেক বেশি। অনেকগুলো ফর্ম নিয়ে চিত্রটি বিন্যস্ত হওয়ায় এই গতি সৃষ্টি হয়েছে, আবার একটি মুহূর্তের আবেদনও এই গতির উৎস। যেমন মাছ ধরার উদ্দেশ্যে জাল পানিতে ফেলে যখন টেনে তোলা হয় তখন নিশ্চিতভাবে একটি গতি ও টেনশন সৃষ্টি হয়। সেই গতিই এই চিত্রের মূল। সে-কারণে ফর্মগুলোও লাভ করেছে এমন গতিশীল রূপ। আসলে একটি শূন্য তলকে বিরচনের মাধ্যমে সুন্দর, অর্থবহ ও সৃজনশীল করার চেষ্টা থেকেই ভাবা হয়েছে ওই আবহটির কথা। এবং সেই অনুযায়ী চিত্রটি পরিকল্পিত হওয়ায় সঞ্চারিত হয়েছে এই গতি । সফটগ্রাউন্ড প্রক্রিয়ায় চিত্রতলের বিভিন্ন স্থানে মশারি, জাল কিংবা মেয়েদের মোজার ছাপ ফেলে সৃষ্টি করা হয়েছে জালের আবহ। এই চিত্রে রং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শিল্পীর সুগভীর চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। চিত্রে কালো রঙের প্রাধান্য সৃষ্টি হলেও শিল্পী এর পাশাপাশি বা এর বিপরীতে একটি সমৃদ্ধ রং ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এটা এমন নয় যে কালো রং ব্যবহৃত হলেই অবশ্যম্ভাবীরূপে একটি সমৃদ্ধ রং নিয়ে আসতে হবে। এটা মূলত সফিউদ্দীন আহমেদের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি কালো রংটিকে আরো অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যেই নানা সমৃদ্ধ রঙের প্রয়োজনীয় সমাবেশ ঘটান। এসব কিছুর যৌথতায় চিত্রটি সার্থকতা অর্জন করেছে।

১৯৬৬ সালে তিনি ডিপএচ মাধ্যমে আঁকেন ‘জাল ও মাছ’-১ ও ২ শীর্ষক দুটি ছাপচিত্র। এ দুটি ছাপচিত্রের ওপরেই তিনি ক্রেয়ন বা চারকোল পেনসিল দিয়ে নতুনভাবে কাজ করেন। সৃষ্টি করেন নানা টোন। উদ্দেশ্য ছিল : পেনসিলের এসব কাজের পর চিত্রটি নতুন যে রূপ নেবে তাকে ধাতুপাতে ফুটিয়ে তুলে নতুনভাবে রঙিন ছাপচিত্র সৃষ্টি করবেন। কিন্তু এ দুই চিত্রের ক্ষেত্রেই সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয় নি। ফলে চিত্র দুটির বর্তমান অবস্থাকে মিশ্র মাধ্যমের টেকনিক বা প্রিন্ট উইথ হ্যান্ড টাচ বলা যায়। উভয় চিত্রেই পরিস্ফুটিত হয়েছে সাদা-কালোর মধ্যে নানা বর্ণবিভা। দুটি চিত্রেই বিরচনের এক ধরনের সমরূপতা আছে। মাছ, জাল, পানির ফোঁটা, পাতার ফর্ম সবকিছু মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছে চেনা জগতেরই এক অচেনা রূপ। দুটি চিত্রেরই উপরিভাগে আছে সূর্যের প্রতীকী ফর্ম। ষাটের দশক থেকে সফিউদ্দীন আহমেদের বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রে প্রতীকী সূর্যের উপস্থিতি লক্ষণীয়। অন্য সবকিছু ছাপিয়ে শিল্পী যেন আলোর প্রত্যাশী।

১৯৬৭ সালেই তিনি এচিং, ডিপএচ, ড্রাই পয়েন্ট ও অ্যাকুয়াটিন্ট প্রভৃতি মাধ্যমের সমন্বয়ে রচনা করেন ‘জাল ও মাছ-৩’ শীর্ষক চিত্রকর্ম। আগের চিত্রদ্বয়ে তিনি ধাতুপাতের পুরো অংশ জুড়ে কাজ না-করে কিছু অংশ ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ চিত্রে ধাতুপাতের সম্পূর্ণ অংশ জুড়েই তাঁর কাজ। তাছাড়া কাট অফ এজ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে প্রতীকী ফর্মের অনেকগুলোর অংশবিশেষকে তিনি চিত্রের বাইরে রেখেছেন। জাল, মাছ, পানির ফোঁটা, নৌকার গলুই প্রভৃতির চেনা-অচেনা প্রতীকী রূপে ভরাট হয়ে আছে চিত্রের জমিন। এ চিত্রে শিল্পীর বিরচনগত দক্ষতাও অসাধারণ। বিরচনের মধ্যে আছে অনেক সূক্ষ্ম ও জটিল ফর্মের বিন্যাস। এচিং মাধ্যমে তিনি সরু মোটা নানা রেখার সাহায্যে জালের আবহ নির্মাণ করেছেন। ডিপএচ মাধ্যমে সৃষ্ট মোটা রেখাগুলোর ওপর অ্যাকুয়াটিন্টের গুঁড়ো ব্যবহার করে শিল্পী ওই অংশগুলোর কালোর ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। রং ব্যবহারেও শিল্পী অনেক বেশি পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রথমে ব্যবহার করেছেন হলুদ, তারপর সবুজ এবং সবশেষে কালো। জমিনের সাদা অংশগুলো মূলত কাগজের রং অর্থাৎ প্লেটের ছেড়ে দেওয়া অংশ। এভাবে চিত্রতলে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন পরত বা গভীরতার নানা স্তর।

১৯৬৮ সালে তিনি আঁকেন ডিপএচ ও অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের সমন্বয়ে ‘জলস্রোতে বৃক্ষপত্র’। এ চিত্রের বিরচন আগের চিত্রটির মতো অত জটিল নয়। রং ব্যবহারেও রয়েছে এই সারল্য। লাল ও কালোে এ দুটি রংই শুধু ব্যবহৃত হয়েছে। সাদা রংটি আসলে প্লেটের ছেড়ে দেওয়া অংশ অর্থাৎ কাগজের রং। এ চিত্রে পানির ফোঁটাগুলো অনেক বেশি প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ডিপএচ মাধ্যমে আঁকা স্থূল রেখাগুলোর কালো রং অ্যাকুয়াটিন্টের গুঁড়োসহযোগে অনেক বেশি গাঢ়। এ চিত্রে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি টেনশন । স্রোতময় পানির ওপর উঁচু গাছ থেকে একটি পাতা পড়লে পানির মধ্যে যে আলোড়ন, চাপ বা গতির সৃষ্টি হয় তা দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। চিত্রের উপরিভাগে সূর্যের প্রতীকী উপস্থিতিও তাৎপর্যময়।

এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের অনুশীলনে এর পরে এক দীর্ঘ বিরতি। পুরো সত্তরের দশক এ মাধ্যমে তিনি আর কোনো কাজ করেন নি। এরপর এ মাধ্যমে আর মাত্র দুটি চিত্র তিনি রচনা করেন। একটি ১৯৮২ সালে, অন্যটি ১৯৮৫ সালে। ‘বিস্মৃত রূপকল্প’ বা ‘ফরগটেন ইমেজ’ (১৯৮২) শীর্ষক ছাপচিত্রটি একটু অদ্ভুত ধরনের। এতে কোনো রং ব্যবহার করা হয় নি। ডিপএচ মাধ্যমে সম্পাদিত এ চিত্রের বিষয় দুটো মাছের অবয়ব। শিল্পীর নিরীক্ষামূলক কাজের একটি দৃষ্টান্ত এটি। কোনো রং ব্যবহার ছাড়া প্রিন্ট নিলে কীরূপ আবেদন সৃষ্টি হয়, শিল্পী এ চিত্রে তা দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন।

সফিউদ্দীন আহমেদ এ ধারার সর্বশেষ চিত্রটিতে শুধু এই দুই মাধ্যম নয়, ছাপচিত্রের সব কটি মাধ্যমকে ব্যবহার করে এক গভীর নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন। চিত্রটির নাম : ‘জলের নিনাদ’ (১৯৮৫)। ছাপচিত্রের সকল মাধ্যমের সফল ব্যবহারে এবং শিল্পীর সারা জীবনের শিল্পসাধনার গভীর অভিজ্ঞতাঋদ্ধ চিন্তাভাবনার সমন্বিত প্রকাশে চিত্রটি সার্থকতা অর্জন করেছে।

এ চিত্রের পরিকল্পনার পেছনেও রয়েছে শিল্পীর বন্যার স্মৃতি। বন্যার সময় পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কী আবহ তৈরি হয় তা তিনি দেখেছেন। তখন থেকেই তাঁর মনের এমন একটি চিত্র সৃষ্টির পরিকল্পনা দানা বাঁধে। তারপর ১৯৫৯ সালে প্যারিস ভ্রমণের সময় এবং আরও পরে সত্তরের দশকে বিশেষত লেনিনগ্রাদ সফরের সময় যখন তিনি অর্কেস্ট্রা শুনতে পান তখন এই পরিকল্পনাটি আরো সুনির্দিষ্ট রূপ নেয়। অর্কেস্ট্রায় একই সঙ্গে থাকে অনেক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, অনেক সুর সৃষ্টির প্রয়াস, এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন অনেক যন্ত্রী। সুর কখনো সূক্ষ্ম হতে হতে একবারে খাদে নেমে যায়, আবার হঠাৎ করে উঠে যায় সপ্তমে। অর্কেস্ট্রা শুনে, অর্কেস্ট্রার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে তিনি ছাপচিত্রের সবগুলো মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে একটি চিত্র রচনা করা যায় তা ভাবতে থাকেন। দীর্ঘদিনের ভাবনারই ফসল এই ‘জলের নিনাদ’। প্রায় তিন বছর লেগেছে চিত্রটি সমাপ্ত করতে। এ চিত্র রচনায় আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, লিফটগ্রাউন্ড, এনগ্রেভিং, ডিপএচ, ড্রাই পয়েন্ট প্রভৃতি মাধ্যমের।

চিত্রটিতে রয়েছে মাছ ধরার একটি আবহ। তারই অনুষঙ্গ হিসেবে আছে জাল। সমগ্র চিত্রতল জুড়ে আছে পানির ফোঁটা। আবার সারা চিত্রতল জুড়েই আছে পানির প্রবাহ। পানির ফোঁটাগুলো উঁচু হয়ে আছে। মনে হবে ইমবস করা। আসলে ডিপএচ পদ্ধতিতে এমনটা করা হয়েছে। এচিংয়ের মাধ্যমে যেমন সরু রেখা সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি স্টপআউটের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জালের আবেদন। এটি হাতে করা। চিত্রতলের ডানপাশে নকশাগুণের কারণে সৃষ্টি হয়েছে একটি স্তরপরম্পরা। একটা বৃত্তের মতো আছে, সেটিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এই নকশার। চিত্রটিতে একটি প্রবাহ আছে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে তার গতি। পানির একটা প্রবাহ এবং সেইসঙ্গে ছায়া দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। বাঁ দিকে মশারির মতো একটি রূপ ফুটে উঠেছে। জিংক প্লেটে এনগ্রেভিং করা যায় না। সে-কারণে বুলি দিয়ে চেপে চেপে শিল্পীকে এগোতে হয়েছে; ফলে ওইরূপ আবেদন সৃষ্টি হয়েছে। চিত্রতলে লক্ষণীয় ছোট ক্ষুদে ক্ষুদে অনেক ফোঁটা। স্টপআউটের ওপর নিডল দিয়ে চাপ দেওয়ার ফলে ওখানকার স্টপআউট উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এসব ক্ষুদে ফোঁটার দাগ। এই চিত্রটির বড়ো সাফল্য হল, চিত্রতলে সাদা রংটিকে সর্বত্র একই ওজনে একই মাত্রায় ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। কোথাও ফেটে যায় নি বা ভেঙে যায় নি। চিত্রতলে কালো রঙের অনুপ্রবেশ রোধের জন্য স্টপআউট সলিউশনের মধ্যে নিডলের দাগ দিয়ে এসিড ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জিংক প্লেটের ওপর প্রথম এচিং মাধ্যমে কাজটি শুরু করা হয়। তারপর ড্রাই পয়েন্টেও কিছু কাজ করা হয়। এবং দুটোর সমন্বয় সাধন করা হয়। পরে অন্য মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে শুরুর কাজ অনেকটা ঢেকে যায়। সাদা ফোঁটাগুলো সৃষ্টি করা হয় ডিপএচের মাধ্যমে। এ সময় সাদা অংশগুলো ছাড়া প্লেটের বাকি অংশ স্টপআউট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সাদা অংশগুলোকে বহুবার এসিডে খাওয়াতে হয়েছে অত্যন্ত সতর্কভাবে তার সমরূপতা রক্ষার প্রয়োজনে। মাছ বা নৌকার মতো যে ফর্মগুলো আছে তার রেখাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে এচিং মাধ্যমে। চিত্রতলে হালকা সবুজ রঙের অংশগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। চিত্রতলে সামান্য উজ্জ্বল রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ড্যাবিং পদ্ধতির। যেসব স্থানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় নি সেসব জায়গায় রকার (মেজোটিন্ট) ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাকুয়াটিন্ট ও সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে কাজ করার সময়ও রকার ব্যবহৃত হয়েছে।

ব্যাপক সময়পরিসরে এরূপ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়ায় চিত্রটি সার্থকতার চূড়াস্পর্শ করেছে।

‘জলের নিনাদ’ চিত্রটিতে যেমন মাধ্যমগত অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে তেমনি এ চিত্রটি নিয়ে রঙের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যাপারেও ছিল শিল্পীর আগ্রহ। তিনি সাদা ডটসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো কালো হবে ধাতবপাতে সেভাবে রং লাগিয়ে এ চিত্রের আরেকটি ছাপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্ভবপর হয় নি। তিনি তাঁর ইচ্ছাটি পূরণ করেন অন্যভাবে। এর একটি প্রিন্টের ওপর চক দিয়ে এর অনেক অঞ্চল কালো করে একটি চিত্র সৃষ্টি করেন। একে মিশ্র মাধ্যমের চিত্র বলা যায়।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।