অ্যাকুয়াটিন্ট

অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৫-৪৬ কালপর্বে মাত্র তিনটি চিত্রকর্ম সম্পাদন করেন। এর মধ্যে ময়ূরাক্ষীর দৃশ্যসংবলিত একটি চিত্র, একটি দুমকার নিসর্গচিত্র এবং অন্যটি কলকাতার কবুতর নিয়ে আঁকা চিত্র। ‘পারাবত’ (১৯৪৫) শীর্ষক এ চিত্রটি তিনি তেলরং মাধ্যমেও আঁকেন।

অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমটিও বেশ ধৈর্যশীল ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। অ্যাসিডে খাওয়ানো ধাতুপাতের বারনিশ ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে তার ওপর রজনের গুঁড়ো ব্যবহার করতে হয়। ধাতুপাতে রজনের গুঁড়ো সমানভাবে প্রয়োগ করার জন্য সাহায্য নিতে হয় একটি বিশেষ ধরনের বাক্সের। পতিত গুঁড়োগুলোকে ধাতবপাতের ওপর শক্ত করে বসানোর জন্য পাতটিকে গরম করতে হয়। এ অবস্থায় চিত্রের কোথাও অ্যাকুয়াটিন্ট না-চাইলে সে-অংশগুলো আগের মতো বারনিশ দিয়ে ঢেকে বারনিশ শুকানোর পর ধাতুপাতকে অ্যাসিডে খাওয়াতে হয়। অ্যাসিডে খাওয়ানোর এই প্রক্রিয়াটি কম-বেশি করতে হয় অ্যাকুয়াটিন্টের আবেদন হালকা বা গভীর করার জন্য। এবং তাতে বিভিন্ন গ্রেড বা মাত্রার অ্যাকুয়াটিন্ট স্তর বা নানা টোনের আবেদন পাওয়া যায়। রজনের গুঁড়ো ব্যবহারের ফলে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফুটকিসংবলিত গ্রেইনি এফেক্ট বা দানাদার ভাবও ছবিতে ফুটে ওঠে এই প্রক্রিয়ায়। পরিকল্পিত এই আবেদনগুলো ছবিতে আনতে হলে শিল্পীকে স্বাভাবিকভাবে ব্যাপক সংযম ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়।

কলকাতার বালিগঞ্জে কয়লার ডিপোতে স্কেচ করতে যেতেন সফিউদ্দীন আহমেদ। সেখানে বস্তির মতো একটি এলাকায় বাঁশের খুঁটির ওপর গরুর গাড়ির চাকা বসিয়ে তার ওপর বাক্স রেখে কবুতরের বাসা তৈরি করা হয়েছিল। এ দৃশ্যটি শিল্পীর মনে গেঁথে গেলে তিনি এর স্কেচ করেন এবং তার ভিত্তিতে দুই মাধ্যমে দুটি চিত্র আঁকেন। ‘পারাবত’ চিত্রটি প্রথমে আঁকেন অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে (এখানে ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে), তারপর তেলরঙে। তামার পাতের ওপর ড্রাই পয়েন্টের আদলে সুচ দিয়ে ড্রইং করে তারপর অ্যাকুয়াটিন্ট পদ্ধতিতে রজনের গুঁড়ো ব্যবহারের মাধ্যমে দানাদার ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রজনের গুঁড়োর হালকা ও মোটা প্রলেপ ব্যবহার করে আনা হয়েছে বর্ণবিভার বৈচিত্র্য। যেমন, চাকার নিচের অংশ সম্পূর্ণ কালো রাখা হয়েছে, যেহেতু সেখানে কোনো আলোই পড়ছে না। অন্যদিকে কবুতরগুলোকে সম্পূর্ণ সাদা রাখা হয়েছে। আলো-ছায়ার ব্যবহারেও ছবিটি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রটির মূল সৌন্দর্য হল, এর বিরচন-কৌশল। চাকাটাকে ডানদিকে কিছুটা কাত করে দেওয়া হয়েছে। দড়িগুলো এ ছবির সংকর্ষকে ধরে রেখেছে। চিত্রতলের পুরো পরিসরের মধ্যে বিষয়কে ভরাট করে তুলে সংহত করা হয়েছে এর বিরচনকে। চিত্রতলে অপ্রয়োজনীয় কোনো পরিসর রাখা হয় নি। কবুতরের সংখ্যাও রাখা হয়েছে সীমিত। কবুতরের সংখ্যা বাড়ানো হলে কম্পোজিশনের গুরুত্বসহ ছবির সামগ্রিক আবেদন হ্রাস পেত। এখানে শিল্পীকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে পরিচয় দিতে হয়েছে অসাধারণ পরিমিতিবোধের ।

‘দুমকার নিসর্গ দৃশ্য’ (১৯৪৫) নিয়ে আঁকা অ্যাকুয়াটিন্ট-চিত্রটির স্বাতন্ত্র্য হল, চিত্রতলের পুরো পরিসর জুড়েই গাছ, গাছের মাঝখান দিয়ে পথ। আকাশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিসর্গের আভ্যন্তর ভাবটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পথের সাদা অংশ, মাঠের ঘাসের অংশ, গাছের কাণ্ড, ছায়া ও পাতার অংশের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে রজনের গুড়ো ব্যবহারের তারতম্য সৃষ্টি করে স্পষ্ট করা হয়েছে। এরই মধ্যে আঁকা হয়েছে মানব অবয়ব। আলো-ছায়ার ব্যবহারেও চিত্রটি তাৎপর্যপূর্ণ।

‘ময়ূরাক্ষী’র দৃশ্য-সংবলিত অ্যাকুয়াটিন্ট-চিত্রটির (১৯৪৫) রয়েছে দুটি ভাষ্য । একটি হালকা টোনের, আরেকটি গাঢ়। এর প্রথমটিতে নদীর অভ্যন্তরস্থ পানি ও চরের অংশের যে রূপ আঁকা হয়েছে তাতে সর্বত্রই পানি একই রকম ঘোলাটে সাদা এবং চর অধিকতর ধূসর ও কাদারংবিশিষ্ট। অথচ দ্বিতীয়টিতে পানির অংশেরই রয়েছে নানা রূপ। শুকনো মৌসুমে ময়ূরাক্ষীর পানি কোথাও কোমরসমান কোথাও আবার পায়ের পাতা ভেজার মতো। এ সময় অনায়াসে সাঁওতাল নারীরা অপর তীরের পাহাড়ি অঞ্চলে কার্যোপলক্ষে আসা-যাওয়া করে। এরই দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে চিত্রটিতে। নদীটা দুবার বেঁকে গেছে। পাহাড়ের যেসব জায়গায় পাথর আছে সেসব অংশকে কালো করে দেওয়া হয়েছে। শিল্পীর গভীর পর্যবেক্ষণের সাক্ষ্য ধারণ করে আছে চরের কাদার ওপর মানুষের পদচিহ্নগুলো। দ্বিতীয়টি বা চূড়ান্তটিতে চিত্রের সাদা অংশগুলো বিশেষভাবে স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল। নারীদেহের সাদা কাপড়কে এবং নদীজলের ওপর কিংবা পাহাড়ি অঞ্চলে পতিত সূর্যের আলোর কারণে উজ্জ্বল অংশগুলোকে এ চিত্রে স্বচ্ছ সাদা করা হয়েছে স্টপআউট দিয়ে।

১৯৪৭ সালে ঢাকায় আসার পর এবং ১৯৫৬ সালে লন্ডন যাওয়ার আগে, একটি মাত্র অ্যাকুয়াটিন্ট-চিত্র (সামান্য কিছু এচিংয়েরও লাইন আছে এ-চিত্রে) আঁকেন শিল্পী। সেটি ‘নৌকায় শূন্য কলস’ (১৯৫৫)। বন্যাক্রান্ত ঢাকার, বিশেষত শিল্পীর বসবাসস্থল স্বামীবাগের, চিত্র এটি। ঢাকা শহরের স্বামীবাগ এলাকাটি তখনও অনেকটা গ্রামের মতো, গাছপালা আচ্ছাদিত এবং ঘরগুলোও আধাপাকা। ঘরের চালার ওপর দিয়ে কলাগাছ উঁকি দিচ্ছে। ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে পরপর দুবছর বন্যার পানি ঢাকা শহর প্লাবিত করায় এখানে নৌকা চলেছে অবাধে। প্লাবিত বাড়িঘরের মধ্য থেকে শূন্য কলস নিয়ে নৌকায় করে খাবার পানি আনতে যাওয়ার দৃশ্য এটি। চিত্রের মধ্যভূমিতে রয়েছে বন্যার পানির মধ্যে বেঁধে-রাখা কয়েকটি খালি নৌকা। প্লাবিত পরিস্থিতিকে এ-চিত্রে যেমন বাস্তবোচিত করে তোলা হয়েছে, তেমনি দক্ষ হাতে প্রযুক্ত হয়েছে আলোছায়ার ব্যবহার। একই সঙ্গে রজনের গুঁড়োর নানা মাত্রার প্রলেপ ব্যবহার করে ঘন কালো, হালকা কালো ও ধূসরতার নানা রূপকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিচিত্র তালিযুক্ত চালাকে এই মাধ্যমে পরিস্ফুটিত করে তোলার কাজটি শিল্পীর পক্ষে সহজসাধ্য হয় নি। এই মাধ্যমকে দক্ষভাবে ব্যবহারেরও সাক্ষ্য হয়ে আছে চিত্রটি।

সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।