জীবনপঞ্জি
১৯২২:
২২ জুন দিবাগত রাতের শেষ প্রহরে, অর্থাৎ ২৩ জুন কলকাতার ভবানীপুরস্থ নন্দন পিতৃগৃহে জন্ম। পিতার নাম : শেখ মতিনউদ্দিন (ওরফে মতিউদ্দিন)। মায়ের নাম বিবি জমিলা খাতুন। চার বছরের বড় একমাত্র বোনের নাম : নুরজাহান বেগম (১৯১৮-২০০০)। তার পিতামহ শেখ আমিনউদ্দিন আহমেদ। (বেচু) পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। তিনি পূর্বপুরুষের বাড়ি চব্বিশ পরগনা থেকে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের নন্দন রোডে এসে আবাস গড়েছিলেন। পেশায় তিনি এতটা সুনাম অর্জন করেছিলেন যে, নন্দন রোডে তার বাড়ির পাশের শাখা সড়কটির নাম তার নামানুসারে রাখা হয়েছিল বেচু ডাক্তার লেন’। নন্দন রোডে থেকে কিছুটা দূরে ভবানীপুর অঞ্চলেই তিনি একটি মসজিদ ও কবরস্থান নির্মাণ করেছিলেন এবং তৎসংলগ্ন কিছু খালি জায়গাসহ একটি ওয়াক্ফ এস্টেট গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পিতামহের মৃত্যুর পরে প্রথমে তার বড় চাচা এবং পরে তার ছোট চাচা এই ওয়াকফ এস্টেটের মোতয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। সফিউদ্দীন আহমেদের তিন চাচা ও চার ফুফুর মধ্যে তার বাবার অবস্থান ছিল ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাবা ছিলেন ভূমি-অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার। চাচাদের একজন প্রকৌশলী, একজন চিকিৎসক ও একজন আইনজীবী ছিলেন। তার ফুফুরাও বিয়ের পর সবাই কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। সফিউদ্দীন আহমেদের নানাবাড়িও ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। তাঁর বাবা-চাচাদের মধ্যে ধর্মবিষয়ক কোন গোঁড়ামি ছিল না। চাচারা বাড়িতে গানের আসর বসাতেন। তার বাবা একতারা-দোতারা বাজাতেন। তার বড় বোন গান গাইতেন। সফিউদ্দীন আহমেদও শিক্ষকের কাছে সেতারবাদন শিখেছেন। পাড়াভিত্তিক খেলাধুলায়ও তার নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল। ওই সময়ে ভবানীপুর অঞ্চলে একটি উন্নত সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল। এর প্রভাব পড়েছিল তাঁদের বাড়িতে এবং তার নিজ জীবনে। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল শেখ সফিউদ্দীন আহমেদ। কিন্তু শিল্পী নিজে পরে নামের প্রথম অংশটি বর্জন করেন। আর্ট স্কুলের সার্টিফিকেটে তার নাম সফিউদ্দীন আহমেদ। উল্লেখ্য, সফিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন তাঁর পিতার অধিক বয়সের সন্তান। এর কারণ, তাঁর পিতার প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন অবিবাহিত ছিলেন। পারিবারিক অনুরোধে তিনি চল্লিশোর্ধ্ব। বয়সে জমিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। তার গর্ভেই নূরজাহান বেগম ও সফিউদ্দীন আহমেদের জন্ম। তাঁর বাবা খুব শৌখিন প্রকৃতির ছিলেন। বাবা-মা উভয়ের মধ্যেই ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ঝোক।।
১৯২৪:
চাকরি থেকে পিতার অবসর গ্রহণ।
১৯২৮:
২৮ ফেব্রুয়ারি ৫৯ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু। এর আগে তাঁর পিতা বেশ কিছুদিন রোগে ভোগেন। চিকিৎসকের পরামর্শে দুবার কলকাতার বাইরে যান – প্রথমবার পুরীর সমুদ্রসৈকতে। বালক সফিউদ্দীনের এই প্রথম সমুদ্র দর্শন। মাস দেড়েক সেখানে অবস্থান শেষে কলকাতা ফিরে কয়েক মাস পর চিকিৎসকের পরামর্শে যান পুরুলিয়া। এবারেও তিনি পিতার সঙ্গী ছিলেন। দুবারের আবহাওয়া পরিবর্তনেও তেমন একটা উন্নতি হয়নি তাঁর স্বাস্থ্যের। পিতার মৃত্যুতে ছ-বছরের বালক সফিউদ্দীনের অনুভূতি হয়েছিল। এরকম : পায়ের নিচের মাটি যেন টলে গিয়েছে। পদ্মপুকুর হাইস্কুলে তখন তিনি প্রথম শ্রেণির ছাত্র। পিতৃবিয়োগের বেদনা তাঁর মনে শুন্যতা সৃষ্টি করেছিল। পিতার মৃত্যুর পর ভবানীপুরের বাড়ির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চাচাদের দ্বারা বিরূপতার শিকার হন তিনি, যা তার মনে এক গভীর তিক্ত অনুভূতি ও সেইসূত্রে প্রচণ্ড জেদের জন্ম দেয়। বাল্যকাল থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোক ছিল। স্কুলে উচ্চ শ্রেণিতে।ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝোকও বেড়ে যায়।
১৯৩৬-৪২:
পদ্মপুকুর হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে এক সতীর্থের সঙ্গে গিয়ে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের।ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে কৃতকার্য হলে ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে সেখানে ভর্তি হন। প্রথমেই শিক্ষক। হিসেবে পান আবদুল মঈনকে (১৯১৩-৩৯)। তিনি ড্রাফটসম্যানশিপে অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আবদুল মঈনই তাঁকে ফাইন আর্ট শাখার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলেন। স্কুলে তার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সুজিত ঠাকুর (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি), মুরলীধর টালি প্রমুখ। সে-সময়ে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। মুকুল দে (১৮৯৫-১৯৯১)। এছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বসন্তকুমার গাঙ্গুলি (১৮৯৩-১৯৬৮), অতুল বসু (১৮৯৮-১৯৭৭), মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত (১৮৯৮-১৯৬৮), রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯০২-৫৫), প্রহাদ কর্মকার, সত্যেন ব্যানার্জি, ঋষেণ মিত্র প্রমুখ। এঁরা সকলেই নিজ নিজ অঙ্কন-দক্ষতা দ্বারা সফিউদ্দীন। আহমেদকে প্রভাবিত করেন।
আর্ট স্কুলে ছ-বছরের কোর্স অধ্যয়নকালে বহির্দশ্য নিয়ে স্কেচ করে তা জমা দেওয়ার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ছিল। বহির্জগৎ বা প্রকৃতি অনুশীলনের উদ্দেশ্যে তিনি সতীর্থদের সঙ্গে গিয়েছেন কলকাতার শিয়ালদা। স্টেশন, আলিপুর কিংবা শহরতলিসহ আশপাশের গ্রামাঞ্চলে। এই সূত্রে তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতিকে ভালোভাবে অনুধাবনের আগ্রহ। প্রকৃতির রূপসকে গভীরভাবে আস্বাদনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিবছর পুজার ছুটিতে সতীর্থদের সঙ্গে চলে গেছেন কলকাতার বাইরে। এ কালপর্বে তিনি গিয়েছেন বিহারের মধুপুর, দেওঘর, জেসিডি, গিরিডি, চাইবাসা, ঝাঝা প্রভৃতি অঞ্চলে। ফাইন আর্ট বিভাগে তিনি জলরং ও তেলরঙে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কাষ্ঠতক্ষণ (উড-এনগ্রেভিং) মাধ্যমটিও গভীরভাবে রপ্ত করেন। এ কালপর্বে আঁকা জলচিত্র : মাছ ধরা’ (১৯৩৮), ‘জড়জীবন’-১ ও ২, জুতো অনুশীলন’ ও ‘অবয়ব অনুশীলন’ (১৯৩৯), লাল সড়ক’ ও ‘নিসর্গ দৃশ্য-১ থেকে ৮ (১৯৪০-৪২)।
এ কালপর্বে দিলীপ দাশগুপ্ত ও অনিল ভট্টাচার্যের সহায়তায় কিছু কমার্শিয়াল কাজ তিনি করেছেন। তাতে অর্থকষ্ট যেমন লাঘব হয়েছে তেমনি কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে বই কেনার সুবিধাও। হয়েছে। বইয়ের মাধ্যমে জেনেছেন পাশ্চাত্যের নানা প্রবণতা সম্পর্কে। এভাবে বই পড়ার আগ্রহ তার মধ্যে স্থায়ী হয়ে ওঠে।
এ কালপর্বেই তিনি যুক্ত ছিলেন নানা খেলাধুলায়। পাড়াভিত্তিক খেলাধুলা ও আর্ট স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উভয় ক্ষেত্রেই তার অংশগ্রহণ ছিল। স্বল্পগতির সাইকেল রেসিং, পোল ভল্ট, হাইজাম্প প্রভৃতিতে অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। চক্রবেড়িয়া ক্লাবে ভলিবল খেলতেন। পদ্মপুকুর সুইমিং ক্লাবের। সদস্য হয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে সাঁতার কাটতে যেতেন।
১৯৩৯:
২৭ ফেব্রুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট আয়োজিত বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি ছাত্রশিল্পীদের ‘গ’ গ্রূপে দুটি পুরস্কার লাভ করেন। সকল মাধ্যমে তিনি ফসল কাটা’ শীর্ষক চিত্রের জন্য দ্বিতীয় পুরস্কার এবং জল রং মাধ্যমে মাছ ধরা’ শীর্ষক চিত্রের জন্য তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এ সময়ে তিনি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
১৯৪০:
ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কলকাতা আর্ট স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর জলরং মাধ্যমের ‘জড়জীবন’ চিত্র এবং “নিসর্গ দৃশ্যগুলো খুবই উচুদরের বলে প্রশংসা লাভ করে। কাষ্ঠতক্ষণ মাধ্যমে আঁকেন বিহারের দৃশ্য। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আর্ট স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর তেলচিত্র প্রশংসা অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কলকাতায় জাপানি বোমা হামলা হলে আতঙ্কিত নগরবাসীর মতো তিনিও ডিসেম্বরে মাকে নিয়ে যান। বাঁকুড়ায় খালার বাড়িতে। সেখানে মাসদুয়েক অবস্থানের পর চূড়ান্ত পরীক্ষার খবর শুনে কলকাতায় ফেরেন।
১৯৪২:
এপ্রিলে ফাইন আর্ট বিভাগ থেকে ছ-বছরের স্নাতক সমমানের কোর্স সম্পন্ন করার পর তিনি জুলাইতে দু-বছর মেয়াদি শিক্ষকতার (টিচারশিপ) কোর্সে ভর্তি হন। এ পর্যায়ে তিনি ফাইন আর্টের পরিবর্তে বেছে নেন ছাপচিত্র বিভাগ। এক্ষেত্রে তাকে উদ্বুদ্ধ করেন রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন। ঘোষাল (কলকাতা আর্ট কলেজের পরবর্তীকালের অধ্যক্ষ), আদিনাথ মুখার্জি প্রমুখ। সেপ্টেম্বর মাসে পূজার ছুটিতে প্রথমবারের মতো যান সাঁওতাল পরগনার রাজধানী দুমকায়। সঙ্গী ছিলেন জ্যেষ্ঠশিল্পী আনওয়ারুল হক। তিনিই তাকে দুমকা যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেখানে ইতিহাসবিদ ড. হবীবুল্লাহর একটি বাড়ি ছিল, সে-বাড়িতেই তারা থেকেছেন। দুমকাতেই তিনি প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণের এক প্রকার স্বচ্ছ দৃষ্টি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে আরো দুবার (১৯৪৪ ও ‘৪৫) তিনি দুমকা যান এবং দুমকার নৈসর্গিক পরিবেশ ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকেন প্রচুর চিত্র।
কাষ্ঠতক্ষণ: বাঁকুড়ার দৃশ্য’ এবং ‘সাঁওতাল নারী ও শিশু’।
১৯৪৩:
দুর্ভিক্ষের কারণে চাকরি নিতে বাধ্য হন; একজন ড্রাফটসম্যানের অধীনে ট্রেচার হিসেবে। তার চাকরিস্থল ছিল হাওড়ায়। ফলে আর্ট স্কুলের শিক্ষকতার কোর্স বাদ দিতে হয়। প্রতিবছরের প্রথামাফিক ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আর্ট স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে দেখা হয় শিক্ষক রমেন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি শিক্ষকতার কোর্স ছাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করে সবকিছু জানার পর নতুন করে ভর্তি হতে বলেন।
কাষ্ঠতক্ষণ : ‘বনপথে দুই সাঁওতাল নারী’ ও ‘হাওড়া’।
১৯৪৪:
রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণায় জুলাই মাসে নতুন করে ভর্তি হন শিক্ষকতার কোর্সে। এবং নতুন উদ্যমে ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমের চর্চা শুরু করেন। সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন হরেন দাস প্রমুখ। এ কোর্সে তার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল কাষ্ঠতক্ষণ, লিথোগ্রাফি ও ম্যুরাল পেইন্টিং। এচিং কিংবা ড্রাইপয়েন্ট পাঠক্রমে ছিল না। তিনি এ দুটি মাধ্যমে ‘অনুশীলন করেন নামেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিশেষ আগ্রহে তার ব্যক্তিগত টুডিওতে তার মেশিন ব্যবহার কৰে। ১৯৪৬ এর প্রথম দিকে রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দিল্লি চলে যাওয়ার। আগ পর্যন্ত তিনি এ সুযোগ পান।
সেপ্টেম্বর মাসে পূজার ছুটিতে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো যান দুমকায়। বিভিন্ন মাধ্যমে দুমকার নিসর্গ ও জনজীবন অবলম্বনে আঁকেন প্রচুর চিত্র।
ডিসেম্বর মাসে সফিউদ্দীন আহমেদসহ চারজনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বেঙ্গল পেইন্টার্স টেস্টিমনি’। অন্য সম্পাদকরা হলেন। অনুণ দাশগুপ্ত, কামরুল হাসান ও আদিনাথ মুখার্জি। সর্বভারতীয় ছাত্র। ফেডারেশনের অষ্টম বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে এটি প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকা লেখেন সরোজিনী নাইডু। এতে বনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, অতুল বসু, জয়নুল আবেদিনসহ আটাশজন শিল্পীর ত্রিশটি চিত্রের রিপ্রোডাকশন মুদ্রিত হয়। এতে সফিউদ্দীন আহমেদের বাড়ির পথে” শীর্ষক কাষ্ঠতক্ষনচিত্রটি ছাপা হয়। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আর্ট স্কুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তার “জড়জীবন চিত্র প্রশংসিত হয়।
ড্রাইপয়েন্ট : ‘আর্ট স্কুলের শ্রেণিকক্ষ’, ‘শালবন ও মোষ’, ‘দুমকা’-১ ও ২, ‘ময়ূরাক্ষী’।
কাষ্ঠতগণ : ‘বাড়ির পথে’ বা ‘ঘরে ফেরা’।
তেলচিত্র : ‘দুমকা চিত্রমালা’ ১১টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘সূর্যালোকে কুটির’, ‘দুমকার কর্মচঞ্চল জীবন’ ও ‘দুমকার পথ-১’।
১৯৪৫:
নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি দিয়ে বছরের শুরুর দিকে রমেন চক্রবর্তী তাকে শান্তিনিকেতনের কলাভবন পরিদর্শনে পাঠান। সঙ্গী ছিলেন সতীর্থ সত্যেন ঘোষাল। কলাভবনে ঢুকতেই রামকিঙ্করের ভাস্কর্য দেখে বিস্মিত হয়ে অনুভব করেন সেখানকার শিল্পের আধুনিকতা। ১৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টের সর্বভারতীয় নবম বার্ষিক প্রদর্শনীতে ‘পারাবত’ শীর্ষক তেলচিত্রের জন্য অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক লাভ। কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা চারশো পঁয়ত্রিশটি চিত্র উপস্থাপিত হয়। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বাংলার গভর্নর আর.জি. কেসি। এ-সময় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টের সভাপতি ছিলেন স্যার আবদুল হালিম গজনবী। প্রদর্শনীতে তাঁর ‘জড়জীবন চিত্রও সমালােচকদের প্রশংসা অর্জন করে।
মার্চ মাসে পাটনায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিল্প প্রদর্শনীতে তার দুটি চিত্র দুশাে পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি হয়। এপ্রিল-মেতে অনুষ্ঠিত কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের দ্বিতীয় বার্ষিক ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়। ড্রাইপয়েন্ট মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট এবং অ্যাকুয়াটিন্টে ‘পারাবত’ ও ‘ময়ূরাক্ষী। সেপ্টেম্বরে পূজার ছুটিতে তৃতীয় বা শেষবারের মতাে যান দুমকায়। এবারও বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকেন প্রচুর চিত্র। দুমকার স্কেচের ভিত্তিতে কলকাতায় ফিরে সম্পন্ন করেন বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্র।
রেখাচিত্র: ‘শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট’।
ড্রাইপয়েন্ট: ‘শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট’, ‘অবয়ব অনুশীলন’ ও ‘ময়ূরাক্ষী তীরে দুই নারী’। অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘পারাবত’, ‘ময়ূরাক্ষী’ ও ‘দুমকার নিসর্গ দৃশ্য’।
কাষ্ঠতক্ষণ: ‘আর্ট স্কুলের পুকুর’।
তেলচিত্র: দুমকা চিত্রমালা ৭টি। উল্লেখযোগ্য: ‘দুমকার পথ’-২ ও ৩’, ‘শালবন দুমকা’, ‘দুমকা-১’ ও ‘দুমকা-২’, ‘পারাবত’।
১৯৪৬:
মার্চ মাসে পাটনা শিল্পকলা পরিষদ আয়োজিত বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীতে ‘শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট’ শীর্ষক চিত্রের জন্য ‘বিহার হেরাল্ড স্বর্ণপদক লাভ। এপ্রিলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকতা কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ। মে মাসে দি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির উদ্যোগে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমকালীন চারুকলা প্রদর্শনীতে অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে আঁকা ‘পারাবত’ শীর্ষক চিত্রটির জন্য পাশ্চাত্য ধারার সাদা-কালো বিভাগে প্রথম পুরস্কার লাভ। পুরস্কারের অর্থ বাবদ পান একশ পঁচাত্তর টাকা। ওই প্রদর্শনীতে তার একটি ছবি একশ পঁচিশ টাকায় বিক্রি হয়। দি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সােসাইটির কাউন্সিল সদস্য মনোনীত হন। জুলাই মাসে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের শিক্ষক (বিষয় : লিথোগ্রাফি) নিযুক্ত হন। ছাপচিত্রের শিক্ষক সুনীল সেন দিল্লিতে চাকরি নিয়ে চলে গেলে পদটি শূন্য হয়েছিল। রমেন চক্রবর্তীর পরামর্শে তিনি লন্ডনে তৈরি একটি এচিং মেশিন কেনেন ছয়শো টাকায়।
১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ আহুত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসটি ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তিনি গিয়েছিলেন জয়নুলের ১৪ নং সার্কাস রো-র বাসায়। সেখান থেকে বিকেলে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের সঙ্গে কলকাতা পার্ক সার্কাসের জনসভার উদ্দেশে রওনা হয়েও শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারেননি। দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে অনেক কষ্টে নন্দন রোডের বাড়িতে পৌছেন । দাঙ্গার কারণে পিতৃগৃহ এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে বদল করে পার্ক সার্কাসের একটি বাড়িতে বসবাসের নতুন ব্যবস্থা করতে হয় তাকে।
বছরের শেষ দিকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত মুসলমান শিল্পীদের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ‘লাল সড়কসহ তার জলচিত্রমালা প্রশংসিত। তার বাড়ির পথে’ শীর্ষক কাষ্ঠতক্ষণ-চিত্রটিও এ-প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক্সপোজিশন ইন্টারন্যাশনাল দেজ আর্ট মডার্ন, মুজে দেজ মডানে অংশগ্রহণ। রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সফিউদ্দীন আহমেদ পর্যন্ত বিশজন বাঙালি শিল্পীর চিত্র এ-প্রদর্শনীতে স্থান পায়। এতে প্রদর্শিত হয় তাঁর দুমকা পর্বের চারটি চিত্র।
তেলচিত্র: প্রতিকৃতি : দিলীপ দাশগুপ্ত’।
১৯৪৭:
ফেব্রূয়ারি লন্ডনে অনুষ্ঠিত সমকালীন ভারতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। এ প্রদর্শনীতে তাঁর ‘দুমকা’ ও ‘পারাবত’ সমালােচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়।
মার্চে বিহারের পাটনা শিল্পকলা পরিষদ আয়োজিত শিল্প প্রদর্শনীতে ‘সূর্যালোকে কুটির’ শীর্ষক তেলচিত্রের জন্য ‘দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক’ লাভ। এবং একই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত সাঁওতাল মেয়ে’ শীর্ষক কাষ্ঠতক্ষণ-চিত্রের জন্য তিনি শিল্পকলা পরিষদের স্বর্ণপদক’ পান। এপ্রিলে দি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির উদ্যোগে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তঃএশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে কাষ্ঠতক্ষণ মাধ্যমে আঁকা সাঁওতাল মেয়ে’ চিত্রটির জন্য সাদা- কালো বিভাগে প্রথম পুরস্কার লাভ। পুরস্কারের অর্থ বাবদ পান একশ টাকা। ওই প্রদর্শনীতে তার দুটি ছবি বিক্রি হয় দেড়শো টাকায়।
এছাড়া ভারতের স্বাধীনতা উপলক্ষে লন্ডনে অনুষ্ঠিত খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ সাল থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের শিল্পকলা প্রদর্শনীতে (১৯৪৭-৪৮) তার চিত্র (সাঁওতাল মেয়ে) স্থান পায়।
১৪ আগস্ট তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ১৫ আগস্ট ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ড্রইং শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন। তখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এনামুল হক (পরবর্তীকালের ভাষাতাত্ত্বিক ও পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত)। এনামুল হক তাঁকে শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করতেন। ঢাকায় এসে প্রথমে কিছুদিন ছিলেন কলতাবাজারের ব্যবসায়ী-বন্ধু মােহাইমেনের বাসায়। পরে টিকাটুলিতে বাসা ভাড়া নেন।
কাষ্ঠতক্ষণ: ‘মেলার পথে’।
তেলচিত্র: ‘লিলি ফুল’।
১৯৪৮:
গত বছরের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে এ বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে কলকাতায় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টের দ্বাদশ প্রদর্শনী। এতে তিনি পুরস্কৃত হন। তাঁর প্রহরীবৃন্দ’ ও ‘পথিপার্শ্বে তরুবীথি চিত্রদুটি সোমালোচকদেরও প্রশংসা লাভ করে।
বছরের শুরুর দিকে টিকাটুলি থেকে ৬১ স্বামীবাগে বাসা ভাড়া নেন তিনি। কলকাতার টালিগঞ্জে বিভাগ-পূর্বকালে নিজের উপার্জিত অর্থে একটি জমি কিনেছিলেন। সেই জমির সঙ্গে বদল করে স্বামীবাগের ওই বাড়ির মালিকানা অর্জন করার পর কলকাতা থেকে মাকে নিয়ে আসেন। কলকাতা নন্দন রােডের পিতৃগৃহটি তিনি নগদ মূল্যে বিক্রি করেন।
জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় হন। এ কাজে একাধিকবার। জয়নুলের সঙ্গে যান চট্টগ্রামে। এই আন্দোলনের ফলে গঠিত হয় গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস’। জয়নুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। সেপ্টেম্বর মাসেই শুরু হয়। এ ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম। তিনি ছাপচিত্র বিভাগের লেকচারার ও প্রধান নিযুক্ত হন। তাঁর মূল বেতন। নির্ধারিত হয় দুশো পঁয়তাল্লিশ টাকা। নবাবপুর রোডে অবস্থিত ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের নিচতলার দুটি কক্ষে এই নতুন প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং এক্সিবিশনে (১৯০০-৪৮) অংশ নেন।
তেলচিত্র: ‘ময়ূরাক্ষী তীরে দুই নারী’।
১৯৪৯:
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ও দেশভাগের ফলে জন্মভূমি থেকে উন্মলিত হয়ে ঢাকায় আসা, তারপর বাড়িবদলের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থাসহ চাকরির একটি সুবন্দোবস্ত হতে পার হয়ে যায় ১৯৪৮ সাল। এ বছর থেকে তিনি নিবিড়ভাবে অবলোকন করেন এই নতুন দেশের ভিন্নতর নৈসর্গিক পরিস্থিতি, এর পাললিক অমি ও তার গাঢ় গভীর সবুজের সমারোহ। যে ধূসরতার মধ্যে বেড়ে উঠেছে তার জীবন তার বদলে সবুজে এই নতুন রূপ তার মনে রঙের ভিন্নতর প্রণোদনা সৃষ্টি করে। এই সবুজকে চিরায়িত করতে তিনি এ বছর থেকেই গতভাবে মনোনিবেশ করেন। এই নতুন দৃষ্টিলাভে সঙ্গে ময়মনসিংহ-ভ্রমণেরও একটা যোগসূত্র হয়তো আছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের এক বার্ষিক বনভোজন উপলক্ষে ময়মনসিংহে গেলে তিনি লাভ করেন পূর্ববাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা।
তেলচিত্র: ‘প্রতিকৃতি’, ‘হামিদুর রাহমান’।
১৯৫০:
পুরোনো ঢাকার গণশীল সম্প্রদায়ের শিল্পচর্চাবিরোধী অবস্থান ও ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে একটি শিল্প আন্দোলন সৃষ্টি প্রয়োজনীয়তা থেকেই জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ডিসেম্বরে গড়ে তোলা হয়। ‘ঢাকা আর্ট গ্রূপ’। সফিউদ্দীন আহমেদ এই এপের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
এ বছরেই তিনি ঢাকার ধানমণ্ডিতে ৪ নম্বর সড়কে এক বিঘাবিশিষ্ট সরকারি প্লটের বরাদ্দ লাভ করেন। জমির মুল্য নির্ধারিত হয় পাঁচ হাজার টাকা। পঞ্চাশ কিস্তিতে এ টাকা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। চাকরির বেতন থেকেই তিনি কিস্তি পরিশোধ করে এ জমির মালিক হন।
রেখাচিত্র : ‘গুণটানা-১’, ‘মাছধরা-১’, ‘দম্পতি’, ‘বেহালাবাদকসহ ছাদ-পেটানাে-১’।
কাষ্ঠতক্ষণ : ছাতিম গাছ’, ‘বাঁশের সাঁকো’।
১৯৫১:
১৬ থেকে ২১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) মিলনায়তন ‘লিটন হলে’ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী। এ-প্রদর্শনীতে তাঁর জলরং, তেলরং, ড্রাইপয়েন্ট ও কাষ্ঠতক্ষণ মাধ্যমে মোট চোদ্দটি চিত্র স্থান পায়। প্রদর্শিত তাঁর তেলচিত্রগুলো দর্শকদের মধ্যে প্রবল। আকর্ষণ সৃষ্টি করে। ‘আমার স্টুডিও’, ‘সাঁওতাল মেয়ে’, ‘সায়াহ্নের আলো’ ও ‘যাত্রার শেষ’ চিত্রগুলো সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়। ১৬-১৭ মার্চ চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন।
রেখাচিত্র : ‘গুণটানা-২ ও ৩।
কাষ্ঠতক্ষণ : বহন’।
তেলচিত্র : ‘গোপীবাগ ‘, ‘বুড়িগঙ্গা-১ ও ২’, ‘মুন্সিগঞ্জ’।
১৯৫২:
ঢাকা আর্ট গ্রূপের দ্বিতীয় প্রদর্শনী উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত ছিল ২২ ফেব্রূয়ারি। কিন্তু ২১ ফেব্রূয়ারির আন্দোলন ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় তারিখ পিছিয়ে ২২ মার্চ ঢাকার পুরনো জাদুঘরে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-আবাস ‘আনোয়ারপাশা ভবন’) উদ্বোধন করা হয় এ-প্রদর্শনীর। এতে প্রদর্শিত হয় তার আটটি চিত্রকর্ম। তার মধ্যে দর্শকচিত্তে সাড়া জাগায় ধান-মাড়ানো’, ‘ব্যস্ত জীবন’, ‘প্রতিকৃতি ; ওয়াজির আলি’ প্রভৃতি তেলচিত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এফ.ডি. রুজভেল্টের স্ত্রী ঢাকা এলে তাঁকে ‘ধানের বাজার’ শীর্ষক একটি তেলচিত্র উপহার দেওয়া হয়। ১৫ আগস্ট রাজশাহীর শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের কন্যা আঞ্জুমান আরার (জন্ম : ২৯ মে ১৯৩৭) সঙ্গে পরিণয়। সাত ভাই ও তিন বােনের মধ্যে আঞ্জুমান আরার অবস্থান ষষ্ঠ ও বােনদের মধ্যে দ্বিতীয়। তার পিতা ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা। পরবর্তীকালে তার দুই ভাই সরকারের সচিব ও এক ভাই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ২২-২৪ আগস্ট কুমিল্লা শহরে কুমিল্লা প্রগতি মজলিস আয়ােজিত সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে যে শিল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় তাতে অংশ নেন। কাষ্ঠতক্ষণ : ‘কৃষক’ (কয়েকটি প্যানেলের দৃশ্য)।
তেলচিত্র : ‘বুড়িগঙ্গা-৩’, ‘ধানের হাট’ ও ‘ধান-মাড়ানো’।
১৯৫৩:
আগস্টে অনুষ্ঠিত হয়। আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম বার্ষিক প্রদর্শনী। স্থান : সেগুনবাগিচা, আর্ট ইনস্টিটিউটের নতুন ভবন। এটি মূলত ছাত্রদের চিত্রপ্রদর্শনী হলেও এতে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে তার চিত্রকর্মও প্রদর্শিত হয়।
১৯৫৪:
১৯ জানুয়ারি বুধবার সকাল ১১টায় ঢাকার স্বামীবাগের বাসায় মায়ের মৃত্যু। বালক বয়সে পিতাকে হারিয়ে মা-ই ছিলেন তার পরম সঙ্গী। মায়ের উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার ছত্রচ্ছায়ায় বিকশিত হয়েছেন তিনি। তাঁর স্বাধীন সিদ্ধান্তে মা কখনো বাধা দেননি। সেই মায়ের মৃত্যু এক গভীর শূন্যতায় তাকে নিপতিত করে।
২ আগস্ট বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় ঢাকা শহর। কলকাতার সন্তান হিসেবে বন্যাসংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। তাই এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। তার স্বামীবাগের বাড়ির মেঝে থেকে পানি ছিল মাত্র চার ইঞ্চি নিচে। নৌকায় করেই যাতায়াত করতে হতো । প্রতিমুহূর্তে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যেই বসবাস। পানির ওপরে দেখেছেন ফড়িং ও প্রজাপতির খেলা, নিচে দেখেছেন। মাছের চলাচল, দেখেছেন পানির ওপরে বৃষ্টিপতনের দৃশ্য ও শুনেছেন তার শব্দ। নৌকা ভাড়া করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির ওপর ভেসে দেখেছেন বন্যার সৌন্দর্য ও ধ্বংসের রূপ। দেখেছেন বন্যার পানির নিঃশব্দ নেমে যাওয়ারও দৃশ্য। এ সবই তার পরবর্তী চিত্রমালায় বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যে এচিং মেশিনটি কিনেছিলেন সেটি ঢাকায় আনা সম্ভব হয়নি সরকারি ছাড়পত্রের অভাবে। মেশিনটি যে ব্রিটিশ-ভারতীয় মুদ্রায় কেনা তার প্রমাণ দেখিয়ে ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হতাে। কিন্তু তিনি মেশিনের ক্রয়-রসিদটি খুঁজে পাননি। এ বছর বইয়ের মধ্য থেকে রসিদটি পেয়ে তিনি ছাড়পত্র সগ্রহ করে মেশিনটি নিয়ে আসেন। কলকাতায় এক আত্মীয়বাড়িতে এটি রেখে এসেছিলেন। নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলস্থ লিটন হলে এক প্রদর্শনীর আয়ােজন করলে তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
কাষ্ঠতক্ষণ : নদী ও নৌকা।
তেলচিত্র : শরবতের দোকান-১’, ‘মুরগির খাঁচা’ ও ‘মাছ ধরা-১’।
১৯৫৫:
বছরের শেষার্ধে আবার বন্যায় প্লাবিত হয় ঢাকা জেলার এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল। বুড়িগঙ্গার পানি ১৯৫৪-র সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে যায়। বন্যাক্রান্ত মানুষের দুর্দশাকে ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতাসহ আবার উপলব্ধি করেন তিনি। ফলে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা প্রভৃতি তাঁর চিত্রতলে স্থায়ীভাবে ঠাই পায়। কাষ্ঠতক্ষণ : ‘গুণটানা’। অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘নৌকায় শূন্য কলস। এচিং : ‘বন্যাপ্লবিত ঢাকা’। অক্টোবরে দুমকা’ শীর্ষক তার আরেকটি চিত্র উপহার দেওয়া হয় মিসেস রুজভেল্টকে। নিজ খরচে লন্ডনে ছাপচিত্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যক্তিগত এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি সবেতন শিক্ষাছুটি নিয়ে নভেম্বরের শেষে কলকাতা হয়ে লন্ডন যান। মাঝখানে করাচিতে যাত্রাবিরতি করেন। লন্ডনে গিয়ে পৌছান ১ ডিসেম্বর। ভর্তি হন লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে। এই স্কুলেরই একসময় ছাত্র ছিলেন তার শিক্ষক রমেন চক্রবর্তী। এ সময়ে ওই স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন উইলিয়াম জোনাটন এবং ছাপচিত্র বিভাগের প্রধান ছিলেন মেলুয়িন ইভানস। তাঁর সরকারি বেতনের অর্থ লন্ডনে পাওয়ার ব্যবস্থা হলে শিক্ষাগ্রহণে আর্থিক বাধা আর থাকে না।
কাষ্ঠতক্ষণ : ‘বন্যা’।
তেলচিত্র : ‘কাঠমিস্ত্রি’ ও ‘সূর্যমুখী’।
১৯৫৭:
তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত একটি দেশ থেকে যাওয়া এই শিক্ষার্থী সম্পর্কে লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুলের শিক্ষকদের মনে প্রথম দ্বিধা-সংশয় থাকলেও তিনি একনিষ্ঠা, শ্রমশীলতা ও জিজ্ঞাসু মন দ্বারা দ্রুতই শিক্ষকদের আকৃষ্ট করেন। এচিংয়ের সঙ্গে নতুন একটি বিষয় কপার এনগ্রেভিংকেও (তাম্রতক্ষণ) তিনি পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া তিনি অয়েল পেইন্টিং, ম্যুরাল পেইন্টিং ও ভাস্কর্য মাধ্যমেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশে দশ বছর শিক্ষকতা করার পরও সেখানে সম্পূর্ণ ছাত্র বনে যান। এতটুকু সময় অন্যদিকে ব্যয় না-করে শুধু শেখার কাজেই মনযোগী থাকেন। এমনকি নিয়মিত স্কুল-সময়ের পরে সান্ধ্যকালীন কাজের সুযোগগুলোও তিনি যতটা সম্ভব কাজে লাগান। ছুটির দিনলোও তিনি আলস্যে কিংবা আড্ডা বা বিনােদনে ব্যয় না-করে মিউজিয়াম পরিদর্শন ও সেখানকার শিল্প-অনুশীলনে মশগুল থাকেন।
রেখাচিত্র : ‘নগ্নিকা অনুশীলন-১’।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : মাছ ধরার সময়’ ও ‘জড়জীবন’ (সূর্যমুখী)।
তাম্রতক্ষণ : জেলের স্বপ্ন’ ও ‘হলুদ জাল’।
তেলচিত্র : নগ্নিকা’-১ ও ২ এবং ‘জড়জীবন-১’।
১৯৫৮:
লন্ডনে তার একাগ্রচিত্তের শিক্ষালাভ পূর্ববর্তী বছরের মতো একই গতিতে অব্যাহত থাকে। ফলে এ বছরের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় বিয়াল্লিশজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনিই একমাত্র এচিং ও এনগ্রেভিং উভয় বিষয়ে ডিস্টিংশন নিয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম শিল্পী যিনি এ দুটি মাধ্যমে রঙিন চিত্র সৃষ্টির দক্ষতা অর্জন করেন।
ডিপ্লোমা অর্জনের পর আরো এক বছর ওই স্কুলে এচিংয়ের সর্বাধুনিক টেকনিকলো রপ্ত করার উদ্দেশ্যে শিক্ষারত থাকার আগ্রহ ব্যক্ত করে ঢাকায় ডিপিআইয়ের কাছে দুটি আবেদন করেন। তার আবেদনের সঙ্গে ওই স্কুলের পেইন্টিং ও এচিং বিভাগের প্রধান মারিয়া ক্যাসেলম্যান এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে জোরালো সুপারিশ প্রদান করলে তার দুটি মধুর হয়। কিন্তু সে-ছুটি হয় বিনা বেতনে। অতঃপর কষ্ট করেই ওই স্কুলে আরো এক বছর উচ্চতর প্রশিক্ষণে রত থাকেন। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রিয়েনিয়াল অফ অরিজিনাল কালার্ড গ্রাফিকে অংশগ্রহণ। ১০ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত লন্ডনের উডস্টক গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের পাঁচ শিল্পীর যৌথ প্রদর্শনীতে তিনিও অংশ নেন। অন্যরা হলেন আহমেদ পারভেজ, আনোয়ার জালাল শেনজা, মুর্তজা বশীর ও আলী ইমাম। প্রদর্শনীতে তার পাঁচটি চিত্রকর্ম ছিল।
রেখাচিত্র : নগ্নিকা অনুশীলন-২’।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘বন্যা-১’, ‘বন্যাপ্লাবিত গ্রাম’ ও ‘ঝড়’ বা ‘এক্সপোজ দি স্টর্ম’।
তাম্রতক্ষণ : কম্পোজিশন ও ‘গুণটানা’।
তেলচিত্র : ‘জড়জীবন-২’ ও ‘মাছধরা-২’।
১৯৫৯:
বছরের শুরুর দিকে লন্ডনের সেইন্ট জর্জ গ্যালারিতে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অফ পেইন্টারস, এচারস অ্যান্ড এনগ্রেভারস আয়োজিত ৭৭তম বার্ষিক প্রদর্শনীতে এবং রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ আর্টের ১৯১তম প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ২০ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত লন্ডনের নিউ ভিশন সেন্টার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী। এতে তার তেলরং এচিং মাধ্যমের মোট ষোলটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। এসব চিত্রকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘মৃত পত্র’, ‘আলো, জল ও জীবন’, ‘নিস্তব্ধ সকাল’, ‘বন্যা’, ‘সেতু পারাপার’, বন্যাক্রান্ত গ্রাম’, ‘সবুজ ও কালো গাছ’, ‘নেমে যাওয়া বান’, ‘মাছ ধরার সময়’, ‘জাল, নৌকা ও সূর্য’, ‘সূর্যমুখী’ প্রভৃতি। লন্ডনে অবস্থানকালে নিয়মিত সেখানকার মিউজিয়ামগুলো পরিদর্শন করেছেন। দেখেছেন শিল্প প্রদর্শনী। এ-সময়ে লন্ডনে আধুনিক ছাপচিত্রের জনক স্ট্যানলি হেটারের একটি ছাপচিত্র প্রদর্শনী দেখার এবং তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। লন্ডনের শিক্ষাশেষে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মিউজিয়াম পরিদর্শন ও শিল্প প্রদর্শনী দেখতে বেরিয়ে পড়েন। এ উদ্দেশ্যে যান ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড। এ ভ্রমণে বিখ্যাত ভেনিস বিয়েনাল দেখার সুযোগ পান তিনি। ডিসেম্বরে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
রেখাচিত্র : নগ্নিকা অনুশীলন’-৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭, এবং অনুশীলন’-১ ও ২।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট ; ‘মেনে যাওয়া বান’, বন্যা-২’ ও ‘সেতু পারাপার’।
১৯৬০:
রেখাচিত্র : ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, বাদামবিক্রেতা-১’, ‘বেহালাবাদকসহ ছাদ পেটাননা-২’ ও শরবতের দোকান’।
তেলচিত্র : ‘প্যারিসে বইয়ের দোকান’।
১৯৬১:
ঢাকার বাংলা একাডেমী আয়োজিত ‘সমকালীন চিত্রকলা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয় তার পাঁচটি এচিং মাধ্যমের চিত্র।
১৯৬২:
এপ্রিলে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের উদ্যোগে ইউনেস্কোর ফেলোশিপের জন্য মনোনয়ন পেলেও এ বছরে দেশের বাইরে যেতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। ২ মে প্রথম সন্তান সাঈদ আহমেদের (স্বপন) জন্ম। ৬ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জাপানের টোকিওতে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল এক্সিবিশন অফ প্রিন্টসে অংশগ্রহণ।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : মাছ ধরার সময়’-১ ও ২।
১৯৬৩:
শিল্পকলায় অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’ লাভ। লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ আর্ট টুডে এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ। ১৯৬৪ : জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল এক্সিবিশন অফ প্রিন্টসে অংশগ্রহণ। ২৩ অক্টোবর দ্বিতীয় সন্তান নাজির আহমেদের জন্য। তার এই কনিষ্ঠ পুত্র শিল্পী হিসেবে আহমেদ নাজির নামে পরিচিত।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘নীল জল’ ও ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’।
১৯৬৫:
পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা কলেজে অনুষ্ঠিত ষোলজন শিল্পীর প্রদর্শনীতে তার পাঁচটি ছাপচিত্র (বিক্ষুব্ধ মাছ’, ‘নীল জল’, ‘সেতু পারাপার’ প্রভৃতি) উপস্থাপিত হয়।
১৯৬৬:
জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল এক্সিবিশন অফ প্রিন্টসে অংশগ্রহণ। ইরানের পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র : ‘নৌকা ও মাছ’।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘জাল ও মাছ’-১ ও ২ এবং ভাসমান জাল’।
১৯৬৭:
রেখাচিত্র : কাপড়বিক্রেতা’-১ ও ২।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট : ‘জাল ও মাছ-৩’।
১৯৬৮:
রেখাচিত্র: ‘ছাপাখানা’, ‘ঘানি-টানা-১’ ও ‘বেলুনবিক্রেতা’।
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট: জলস্রোতে বৃক্ষপত্র।
১৯৬৯:
১৪ সেপ্টেম্বর তৃতীয় সন্তান একমাত্র কন্যা সেলিনা আহমেদের (রত্ন) জন্ম।
১৯৭১:
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ঢাকাতেই স্বামীবাগের নিজ বাসভবনে প্রবল আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন। কখনো না জেনে বাজার করার জন্য বেরিয়ে কারফিউর মধ্যে পড়েছেন। কখনো কারফিউর অবরোধের মধ্যে নিজ গৃহের জানালার খড়খড়ির ফাক দিয়ে অবলোকন করেছেন প্রতিবেশীর গৃহে পাকিস্তানি বাহিনীর তল্লাশি।
১৯৭৩:
ভারতের কলকাতা, নয়াদিল্লি ও বোম্বেতে অনুষ্ঠিত কনটেম্পোরারি আর্ট অফ বাংলাদেশ’ শীর্ষক চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং এ উপলক্ষে ভারত ভ্রমণ।
১৯৭৪:
সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর এবং সেখানকার বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়াম পরিদর্শন।
১৯৭৫:
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত প্রথম জাতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনীতে এবং এর চতুর্দশ প্রদর্শনী (২০০২) পর্যন্ত প্রতিটিতে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ।
তেলচিত্র : ‘মাছ ধরার জাল’।
১৯৭৬:
রেখাচিত্র: ‘মাছধরা-২’, ‘পালতোলা নৌকা’ ও ‘ঘানি-টানা-২’।
১৯৭৭-৭৮:
পোল্যান্ড জুগোস্লাভিয়া (সেপ্টেম্বর) ও বুলগেরিয়ায় (মার্চ ১৯৭৮) অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের কনটেম্পোরারি গ্রাফিক আর্টস শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ১৯৭৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ঢাকার সাজু আর্ট গ্যালারির বার্ষিক প্রদর্শনীসমূহে অংশগ্রহণ।
১৯৭৮:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান হিসেবে একুশে পদক’ লাভ।
রেখাচিত্র: ‘অনুশীলন-৩’ ও ‘বাদামবিক্রেতা-২’।
১৯৭৯:
লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ‘আর্টস অফ বেঙ্গল – দি হেরিটেজ অফ বাংলাদেশ অ্যান্ড ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ।
১৯৮০:
জাপানের ফুকুওকা আর্ট মিউজিয়াম কর্তৃক আয়োজিত কনটেম্পোরারি আর্ট শোতে এবং হংকংয়ে এশীয় শিল্পকলার ষষ্ঠ উৎসব উপলক্ষে কনটেম্পোরারি বাংলাদেশ আর্ট’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র: সূর্যমুখী’-১ ও ২।
তাম্রতক্ষণ: ‘কান্না।
তেলচিত্র: ‘কাঠাল গাছ’।
১৯৮১:
ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে এবং এর অষ্টম প্রদর্শনী (২০০১) পর্যন্ত প্রতিটিতে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ।
১৯৮২:
এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট: ‘বিস্মৃত রূপকল্প’।
১৯৮৩:
ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত গ্রাফিক প্রিন্ট প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
১৯৮৪:
চিত্রশিল্পে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সম্মাননা লাভ। বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত নববর্ষ চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
তেলচিত্র : ‘বৃক্ষ’ ও ‘কালো মাছ’।
১৯৮৫:
বাংলা একাডেমীর সম্মানসূচক ‘ফেলা’ মনােনীত। এচিং ও মিশ্র মাধ্যম। “জলের নিনাদ’-১ ও ২।
১৯৮৬:
তৃতীয় দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ কর্তৃক তাঁর মাছ।ধরার জাল’ শীর্ষক চিত্রকর্ম অবলম্বনে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ।
১৯৮৭:
রেখাচিত্র : ‘একুশে স্মরণে’-১ ও ২।
তাম্রতক্ষণ : ‘একুশে স্মরণে’।
তেলচিত্র : ‘জড়জীবন-৩’।
১৯৮৮:
চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যােগদান। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত। রেখাচিত্র : বন্যা-১’। তাম্রতক্ষণ : ‘একাত্তরের স্মৃতি’।
তেলচিত্র: ‘জড়জীবন-৪’ ও বন্যা-১’।
১৯৮৯:
কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র: মুরগির খাঁচা’।
তেলচিত্র: ‘সূর্য, বৃক্ষ ও নারী’।
১৯৯০:
জিম্বাবুয়ের হারারেতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রকলা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
১৯৯১:
তেলচিত্র: ‘মাছ ও জাল-১’।
১৯৯২:
রেখাচিত্র: ‘বন্যা’-২ ও ৩, ‘কৃষক ও গরু’, ‘ফলবিক্রেতা’ ও ‘কালাে চিত্রমালা’-১, ২ ও ৩।
১৯৯৩:
কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের কনটেমপােরারি গ্রাফিক আর্ট’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে এবং ঢাকার লা। গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র: ‘কালাে চিত্রমালা’-৪, ৫, ৬ ও ৭।
তেলচিত্র: ‘আপেল ও গাড়ি।
১৯৯৪:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়ােজিত।
রেখাচিত্র : ‘কালাে চিত্রমালা’-৮ থেকে ১৮, জাল ও মাছ’, ‘বাগান’, নিঃসঙ্গ নারী’, ‘বন্যা-৪ ও ৫, এবং বন্যা : সুখ-দুঃখের বাংলাদেশ’।
তেলচিত্র : বন্যা-২’ এবং ‘লাল ও সবুজ।
১৯৯৫:
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘দি পাইওনিয়ার আর্টিস্টস অফ বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র : কালাে চিত্রমালা’-১৯ ও ২০।
১৯৯৬:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসােসিয়েশন সম্মাননা লাভ।
তেলচিত্র : ‘নারী’, ‘একাত্তরের স্মরণে’, ‘মাছ ও জাল-২’ এবং “জীবন’।
১৯৯৭:
ওমানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ পেইন্টিং এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে ‘সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্র’ শীর্ষক ফোলিও প্রকাশ।
১৯৯৮:
বাংলাদেশের চারুশিল্পের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমীর সম্মাননা লাভ।
রেখাচিত্র : ‘প্রতীকী মাছ’।
তেলচিত্র : ‘রেখা ও রূপের ছন্দ-১।
১৯৯৯:
রেখাচিত্র : ‘দুই মুখ’।
২০০০:
ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে, বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ছয়জন প্রখ্যাত শিল্পীর ‘দীঘল’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও চারুশিল্পী সংসদের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রথম দ্বিবার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ঋষিজ শিল্পী গােষ্ঠী পদক লাভ। রেখাচিত্র : ‘মুখ অনুশীলন’।
২০০১:
ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে অনুষ্ঠিত চোদ্দজন শিল্পীর ‘রেখার ছন্দ’ শীর্ষক রেখাচিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র : ধান মাড়াই’ ও ‘বন্যা-৬’।
তেলচিত্র : ‘রেখা ও রূপের ছন্দ-২’ ও প্রকৃতির সংগীত-২’।
২০০২:
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ছয়জন ছাপচিত্রীর প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে মাহমুদ আল জামান রচিত সফিউদ্দীন আহমেদ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ ।
তাম্রতক্ষণ : ‘একাত্তরের স্মরণে’।
তেলচিত্র : মাছ ও জাল-৩’ এবং ‘নীলের নিনাদ-২’।
২০০৩:
ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের চার পথিকৃৎ ছাপচিত্রীর প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র : ‘রেখার ছন্দ’ ও ‘বন্যা-৭’।
২০০৪:
রেখাচিত্র : বৃক্ষ’-১ ও ২, ‘কুমোর, ‘পত্রহীন বৃক্ষ’, ‘কালোর বিন্যাস’ ও ‘বন্যা-৮’।
তেলচিত্র : ‘মাছ’।
২০০৫:
রেখাচিত্র : ‘জাল ও মাছ’, ‘বৃক্ষ-৩’ ও ‘ঝড়ো হাওয়া’।
তেলচিত্র : ‘দুই অবয়ব’ এবং ‘রেখা ও রূপের ছন্দ-৩’।
২০০৬:
নভেম্বর মাসে দুর্ঘটনার শিকার হলে বা পা ভেঙে যায়। ঢাকার বাংলাদেশ মেডিক্যাল হাসপাতালে পায়ের অস্ত্রোপচার করার পরও তিনি হাঁটতে পারছেন না। ফলে তখন থেকে শয্যাশায়ী।
রেখাচিত্র : বৃক্ষ-৪’।
২০০৭:
২২ জুন ধানমণ্ডির ৪ নম্বর সড়কে নতুন ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু। প্রায় ৫৯ বছর (১৯৪৮-২০০৭) স্বামীবাগের বাড়িতে বসবাসের পর শয্যাশায়ী অবস্থায়ই পরিবর্তিত হলো তার স্থায়ী বাসস্থল। ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ছয় প্রখ্যাত শিল্পীর ‘জড়জীবন’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।
রেখাচিত্র : বৃক্ষ-৫’।
২০০৮:
বছরের শুরুর দিকে জাপানের ফুকুওকা আর্ট মিউজিয়াম তার ‘জড়জীবন-৪’ শীর্ষক তেলচিত্রটি (১৯৮৮) সংগ্রহ করে। ২৩ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় রেখার অশেষ আলাে’ শীর্ষক তার প্রথম একক রেখাচিত্র প্রদর্শনী। এটি তার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে সফিউদ্দীন আহমেদের রেখাচিত্র’ শীর্ষক ফোলিও প্রকাশ।
রেখাচিত্র : মুরগিশূন্য খাচা’।
২০০৯:
২৩ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত রেখার অশেষ আলাে’ শীর্ষক তাঁর একক রেখাচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ট্যাগাের সেন্টারে। ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এ-প্রদর্শনী।
২০১০:
ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়ােজিত সজনে ও শেকড়ে’ শীর্ষক দশ প্রদর্শনীর প্রথমটিতে (১৬-৩০ এপ্রিল) দশ শিল্পীর অন্যতম হিসেবে উপস্থাপিত হয় তার চারটি ছাপচিত্র। ২৬ নভেম্বর থেকে বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত হয় দুই পর্বে বিভক্ত তাঁর জীবনব্যাপী আঁকা সব মাধ্যমের শিল্পকর্মের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রদর্শনী।
২০১১:
ইতালির বিখ্যাত শিল্প-প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান SKIRA ও ঢাকার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পসমগ্র নিয়ে ইতালি থেকে প্রকাশিত হয় Great Masters of Bangladesh সিরিজের প্রথম বই Safiuddin Ahmed।
২০১২:
১৯ মে দিবাগত মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২০ মের প্রথম প্রহরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে সফিউদ্দীন আহমেদের জীবনাবসান ঘটে।
সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।