জলচিত্র
সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্রী হিসেবে বিখ্যাত হলেও তেলচিত্র ও রেখাচিত্রেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতার বিষয়ে দেশের শিল্পী ও শিল্পানুরাগী মহল বিশেষভাবে অবহিত। কিন্তু জলরঙের (ওয়াটার কালার) চিত্রকর হিসেবে তাঁর পরিচয়টি এতকাল অজানাই ছিল। কারণ, ছাত্রজীবনের পরে তিনি এই মাধ্যমে আর কোনো ছবি আঁকেন নি। শেষ জীবনে রেখাচিত্রের কিছু কাজে জলরঙের সামান্য ব্যবহার করেছেন শুধু।
ছাত্রজীবনে তিনি জলরং মাধ্যমে যেসব চিত্র আঁকেন তার মধ্যে চৌদ্দোটি এখনো তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত আছে। এগুলো আঁকা হয়েছে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে। এর মধ্যে পাঁচটিতে আঁকা হয়েছে কলকাতার জীবনচিত্র (অঙ্কনসাল : ১৯৩৮-৩৯) এবং বাকি নয়টিতে বিহার প্রদেশের নিসর্গ। ছাত্রজীবনে তিনি একাধিকবার পূজার ছুটিতে বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। এরই কোনো এক বা একাধিক অঞ্চলের নিসর্গচিত্র পরিস্ফুট হয়েছে এসব ছবিতে।
কলকাতা আর্ট স্কুলে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় (১৯৩৮-৩৯) সফিউদ্দীন আহমেদ জলরং মাধ্যমে পাঠ গ্রহণ করেন বসন্তকুমার গাঙ্গুলি ও মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের কাছে। এর প্রথমজন ফ্রান্স থেকে এবং শেষোক্তজন শান্তিনিকেতন থেকে শিল্পশিক্ষা নেন। প্রথমজন স্বচ্ছ জলরঙের ব্রিটিশ টেকনিক সম্পর্কে এবং শেষোক্তজন নন্দলাল বসুর ছাত্র হিসেবে নব্যবঙ্গীয় ধারার ওয়াশ টেকনিক সম্বন্ধে পারদর্শী ছিলেন। সফিউদ্দীন আহমেদের জলরং চিত্রে এ দুই টেকনিকের মিশ্রণ লক্ষণীয়। তাঁর জলচিত্রে ব্রিটিশ টেকনিক অনুযায়ী স্বচ্ছতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অনচ্ছতাও। এসব চিত্রে ব্যবহৃত রঙের মধ্যে আছে : কোবাল্ট ব্লু, ক্যাডমিয়াম ইয়েলো, ক্রিমিনসন লেক, ভারমিলিয়ন প্রভৃতি। এসব জলচিত্রে তিনি ‘S. Ahmed’ হিসেবে সংক্ষেপে সই করেছেন।
জলচিত্রের প্রথম কাজটির (‘বড়শি দিয়ে মাছ-ধরা’ : ১৯৩৮) বিষয : বড়শি দিয়ে মাচায় বসে উদোম গায়ে একজনের মাছ ধরা। এটি কলকাতারই কোনো এক জলাশয়ের চিত্র। প্রকৃতিতে প্রভাত কিংবা গোধূলির কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসরতা। আর এই ধূসরতা সৃষ্টিতে নব্যবঙ্গীয় ধারার ওয়াশ টেকনিক ব্যবহার করেছেন শিল্পী। বিষয়টি বাইরে থেকে স্কেচ করে এনে সম্ভবত আর্ট স্কুলের শ্রেণি-কাজ হিসেবে সম্পন্ন করা হয়েছে। সম্ভবত এটি আঁকা হয়েছে মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের ক্লাসে। প্রথমে রং দিয়ে তার ওপর শুধু পানির ওয়াশ দিয়ে চিত্রতলকে কোমল ও মসৃণ করা হয়েছে। সবশেষে চিত্রিত হয়েছে অবয়ব ও বিষয়ের অনচ্ছ অংশ। প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে পুকুরের পানি ও আকাশ ধূসরতায় যে একাকার সে-সম্পর্কে শিল্পীর সচেতনতার দিকটি চিত্ররূপ দেখে উপলব্ধি করা যায়।
একই মাধ্যমে শ্রেণি-অনুশীলন হিসেবে সম্পাদিত হয়েছে দুটি জড়-জীবনচিত্র (১৯৩৯)। ‘জড়জীবন-১’ চিত্রে টকটকে লাল ড্র্যাপারির সামনে সাজানো বিষয়ের মধ্যে আছে : বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, পেয়াজ, গাজর, আলু ও মিষ্টি কুমড়ার খণ্ডাংশ। ‘জড়জীবন-২’ চিত্রের ড্র্যাপারি অতটা লাল নয়। এতে উপাদানের মধ্যে আছে : ডাঁটাসহ পেয়াজ, পাকা কলা ও কুমড়ার ফালি। ‘জড়জীবন-১’এ ব্যবহৃত রং সত্তর বছরের ব্যবধানেও অসাধারণভাবে উজ্জ্বল। ব্রিটিশ টেকনিকে আঁকা এ দুই চিত্রে স্বচ্ছ ও অনচ্ছ রূপের সংমিশ্রণ ঘটেছে। জড়জীবন-চিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, বিরচন ও আলো-ছায়া ব্যবহারের ওপরই আরোপিত হয়েছে অধিকতর গুরুত্ব। বাইরে থেকে আসা আলোকে পরিস্ফুটিত করে তোলাই এখানে শিল্পীর কৃতিত্ব। বস্তুসামগ্রীর রং যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলাও এখানে সার্থকতার পূর্বশর্ত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আলো-ছায়ার মাধ্যমে বস্তুসামগ্রীর ওজন ও ভল্যুমকে চিহ্নিত করার কাজটি। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্পীর সতর্কতা ও সাফল্য দৃষ্টিগ্রাহ্য। ‘জড়জীবন-১’ চিত্রটিতে শুকনো পেয়াজ ও খোসাহীন পেয়াজের দুই রূপের বাস্তবধর্মী চিত্রণেই শিল্পীর সাফল্যকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এ চিত্রটি অধিকতর অনচ্ছ। অন্যদিকে ‘জড়জীবন-২’ চিত্রে স্পষ্ট হয়েছে হালকা ওয়াশের ছাপ। চিত্রের স্বচ্ছতা অনেক সমৃদ্ধ। ফুটে উঠেছে কোমলতা। হালকা ওয়াশের মাধ্যমে সবগুলো বস্তুর ওজন সৃষ্টি সহজসাধ্য নয়। স্বচ্ছতার মধ্যে তা ফুটিয়ে তুলে শিল্পী কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
‘জুতো অনুশীলন’-এর চিত্রটি (১৯৩৯) শিল্পী সম্পাদন করেছেন কলকাতায় নিজ বাড়িতে নিজের স্যান্ডেল শ্যুকে অবলম্বন করে । সে-সময়ে জলরঙের জন্য এক ধরনের বোর্ড পাওয়া যেত। কাগজ ভিজিয়ে তার ওপর রেখে ছাপ দিলে মাউন্ট হয়ে যেত। এই চিত্রকর্মের কাগজটিকে ওই পদ্ধতিতে মাউন্ট করা হয়েছে। বসন্তকুমার গাঙ্গুলিই পদ্ধতিটির শিক্ষাদাতা। সে-সময়ে জলরং মাধ্যমে কাজ করার একটি নিয়ম ছিল যে, প্রথমেই হলুদ রং দিয়ে শুরু করতে হবে। এ চিত্রেও তা করা হয়েছে। তবে কিছুদিন পরে এ নিয়ম আর থাকে নি। এ চিত্রেও ফুটে উঠেছে শিল্পীর বিরচনের দক্ষতা। স্যান্ডেলের ধূসর রং ফুটিয়ে তোলার স্বার্থেই সৃষ্টি হয়েছে লাল রঙের পরিপ্রেক্ষিত।
‘অবয়ব অনুশীলন’ (১৯৩৯) শীর্ষক চিত্রটির বিষয় কলকাতা আর্ট স্কুলের মডেল। মাথা ও মুখের অংশটিই চিত্রে আঁকা হয়েছে। চিত্রে মাথার ওজনকে ধারণ করার পাশাপাশি মুখের যে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা একজন ছাত্রের কাজ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। জলরং মাধ্যমে শিল্পীর নিসর্গচিত্র, জড়জীবনচিত্র আমরা পাই, কিন্তু প্রতিকৃতি অঙ্কনের দৃষ্টান্ত এই একটিই।
কলকাতার বাইরে বিহারের নিসর্গদৃশ্য নিয়ে আঁকা নয়টি জলচিত্রের মধ্যে প্রথমেই ‘রেড রোড’ বা ‘লাল সড়ক’ উল্লেখযোগ্য। লাল মাটির কাঁচা সড়কের দুপাশে হালকা বৃক্ষসারি, পেছনে অস্পষ্ট ধূসরতায় নাতিউচ্চ পর্বতশ্রেণির ক্ষীণ আভাস। সড়কটি ছবির পুরোভূমির (ফোরগ্রাউন্ড) পুরোটা জুড়ে শুরু হয়ে ক্রমশ সরু হয়ে বেঁকে গেছে। এতে যেমন শিল্পীর পরিপ্রেক্ষিত-জ্ঞানের পরিচয়টি স্পষ্ট হয়েছে তেমনি কোথাও বৃক্ষচ্ছায়ার চিত্রায়ণে অভিব্যক্ত হয়েছে বাস্তবনিষ্ঠাও। ঘন সবুজ পত্রে আচ্ছাদিত সরু তরুশ্রেণির পাশেই পত্রহীন কাণ্ডসর্বস্ব বৃক্ষের সারি। রং ঝরিয়ে দিয়ে আঁকা হয়েছে ছবিটি। চিত্রটিতে রয়েছে বৃহত্ত্বের ব্যঞ্জনা।
‘নিসর্গ দৃশ্য-১’ চিত্রটি আকাশ ও মাটির আনুপাতিক বিন্যাসে তাৎপর্য অর্জন করেছে। ছবির পুরোভূমিতে লাল মাটি ও সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ও পশ্চাদ্ভূমিতে (ব্যাকগ্রাউন্ড) বিশাল আকাশ, মধ্যভূমিতে (মিডগ্রাউন্ড) ঘন সবুজ পত্রে আচ্ছাদিত নাতিউচ্চ তরুরাজি ও পাহাড়। বৃক্ষ ও পাহাড়ের সংকীর্ণ রেখাটি আকাশ ও প্রান্তরকে বিভক্ত করেছে। চিত্রতলের বেশিরভাগ স্থান জুড়েই আকাশের সীমাহীন বিস্তার। পুরোভূমির উন্মুক্ত প্রান্তর ও পশ্চাদ্ভূমির বিপুল বিস্তৃত আকাশ দর্শক-মনে বিশালত্বের যে বোধ সৃষ্টি করে সেখানেই এরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যের সার্থকতা। জনহীন এই প্রান্তর মহাবিশ্বের বিপুল ঔদার্যকেই শুধু আহ্বান করে, মহত্ত্বের প্রেরণা জোগায়। প্রান্তরের হালকা লাল ও হালকা সবুজ, বৃক্ষপত্রের ঘন সবুজ, পর্বতশ্রেণির ধূসরতা এবং আকাশের বিবর্ণ সাদা ও হালকা নীল প্রভৃতি বর্ণকে শিল্পী দক্ষতার সঙ্গে চিত্রতলে বিন্যাস করেছেন।
‘নিসর্গ দৃশ্য-২’ চিত্রটিতে হালকা লাল মাটির কাঁচা রাস্তার ওপরে রেল লাইনের মতো ট্রলি চলাচলের ব্যবস্থা। এছাড়া সারিবদ্ধ খাম্বা দেখে মনে হয়, আশেপাশে রয়েছে কোনো কারখানা। দূরে পাহাড়। চিত্রতলের অধিকাংশ স্থান জুড়েই ছড়ানো ছিটানো হালকা ঝোপঝাড়সহ উন্মুক্ত প্রান্তরের বিস্তার। চিত্রতলে আকাশের পরিসর তাই সংকীর্ণ। সড়কপথটি ক্রমশ সরু হয়ে সুদূরে মিলিয়ে গেছে। ঘন সবুজপত্রে আচ্ছাদিত ঝোপজঙ্গলের মধ্যে লাল টালিতে ছাওয়া বাড়িঘরে লোকবসতির চিহ্ন। জলরঙের ওয়াশ কোথাও গাঢ় কোথাও হালকা।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৩’ চিত্রের পরিসর বিভাজনে আকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অধিক মাত্রায়। তবে শাখা-প্রশাখা-পত্র-পল্লবে বিকশিত আকাশস্পর্শী সুউচ্চ কয়েকটি বৃক্ষই এ চিত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। গাছের পাতা সবুজ, কিন্তু কাণ্ড বাদামি। পরিপ্রেক্ষিতের সামঞ্জস্য সৃষ্টির অভিপ্রায়েই পুরোভূমির বৃক্ষ আকারে এমন বিশাল, অথচ পশ্চাদ্ভূমির তরুশ্রেণি উচ্চতায় স্বাভাবিকভাবে খর্ব। হলুদ রঙের ঘন আবহে উন্মুক্ত প্রান্তরটি রৌদ্রালোকে উজ্জ্বল। মাঠের এই ঔজ্জ্বল্য প্রভাবিত করেছে আকাশের রংকেও। ঘন হালকা নানা মাত্রার ওয়াশে, আলোকসম্পাতে, পরিসরের সুনির্দিষ্ট বিভাজনে চিত্রটি সার্থক।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৪’ চিত্রেও ঘন সবুজ পত্রাচ্ছাদিত তরুশ্রেণি, অনেকটা ঝোপের মতো। যেন সবুজের সমাহার। কালো-লালের মিশ্রণে ধূসর মাটি, পশ্চাদ্ভূমিতে ধূসর পাহাড় ও তার পেছনে আকাশ। আকাশ এখানে প্রধান নয়। ভূমিও নয় সমতল। হলুদের আবহে রৌদ্রালোকের বিস্তার। কাগজ প্রথমে ভিজিয়ে রং ঝরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর একটু একটু করে বিষয়বস্তুকে স্পষ্ট করা হয়েছে ঘন ও হালকা ওয়াশের মাধ্যমে। দেখে মনে হয়, হলুদাভ কাগজের ওপর চিত্রটি আঁকা এবং কাগজের উপরের অংশে যেখানে আকাশ সেখানে কাগজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কোনো ওয়াশই দেওয়া হয় নি।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৫’ চিত্রটিতে পাহাড় অনেক উঁচু। পাহাড় এখানে পশ্চাদ্ভূমিতে নয়, মধ্যভূমিতে। আকাশ অনেকটা ঢেকে গেছে পাহাড়ের উচ্চতায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হালকা গাছপালার মধ্যে লাল টালিতে ছাওয়া বাড়িঘরের অস্তিত্ব। বাঁ পাশে দু-একটি বৃক্ষ ছাড়া চিত্রের পুরোভূমির দিকটা একেবারে শূন্য। উন্মুক্ত সমতল মাঠের এমন বিস্তার বেশ মোহনীয়। এ চিত্রেও হলুদের আবহ এনে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে রৌদ্রোজ্জ্বল পরিস্থিতি। মাঠের রূপকে এমন আলোকিত করা না-হলে পাহাড়ের ধূসরতা ফুটত না।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৬’ চিত্রটিতে আমরা প্রথম নদীর উপস্থিতি পাই। আরও দুটি জলচিত্রে নদীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। যদিও এসব জলচিত্র বিহারের পাহাড়ি দৃশ্য অবলম্বনে অঙ্কিত, কিন্তু লক্ষণীয় যে, নদীগুলো বাংলাদেশের মতো কানায়-কানায় পূর্ণ। বর্ষাকাল হয়ত এর কারণ। এ চিত্রে নদীটি ছবির ডানদিক থেকে এসে বাঁদিকে গিয়ে আবার ডানদিকে মোড় নিয়েছে। বাঁ পাশের সামান্য তীরে স্বল্পপত্রের দুটি গাছ, অন্য তীরে হালকা ছড়ানো ছিটানো স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ঝোপসদৃশ তরুশ্রেণি। পশ্চাদ্ভূমিতে পাহাড়। তারও পেছনে আকাশ সংকীর্ণ। নদীজলে গাছের প্রতিবিম্ব। নদীজলে নীল ও ধূসরের মিশ্রণ।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৭’ চিত্রটিতেও পাহাড় ও নদীর উপস্থিতি। ধূসর রঙের পাহাড়ের নিচে নদীর হালকা কালো জল। পশ্চাদ্ভূমিতে আকাশের পরিসরকে সংকীর্ণ করে তুলেছে পাহাড়ের উচ্চতা। পুরোভূমির প্রান্তরের ভাগ বি¯তৃত। বৃক্ষরাজি স্বল্প পরিসরবিশিষ্ট। দূরে বহুদূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লাল বাদামি রঙের টালিতে ছাওয়া ঘরবাড়ির অস্তিত্ব। এই প্রথম নিসর্গ চিত্রে লক্ষযোগ্য মানুষের উপস্থিতি । তিনটি অবয়বের কালো উদোম শরীর। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের ছবি। গাছের ছায়া দেখে যেমন, তেমনি মাঠের রং থেকেও তা স্পষ্ট হয়। সেখানে সবুজের সঙ্গে হলুদের মিশ্রণ। রং ব্যবহারে শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় রয়েছে। পাহাড় ও আকাশের ধূসরতাকে তিনি পৃথক করে তুলেছেন। আবার বৃক্ষচ্ছায়া ও নদীজলে মানুষের প্রতিবিম্ব এঁকে পরিচয় দিয়েছেন বাস্তবনিষ্ঠার।
‘নিসর্গ দৃশ্য-৮’ চিত্রে পাহাড় নেই। আছে ভূমির অসমতলতা। নদীর এক মোহনার চিত্র। নানা দিকে ছড়িয়ে গেছে নদী। নদীর অপর তীরে লাল টালিতে ছাওয়া একটিমাত্র ঘর মনুষ্য বসতির আভাস দিচ্ছে। চিত্রতলে আকাশের চেয়ে ভূমির ভাগই বেশি, কিন্তু আকাশের বিশালত্ব তাতে ঢাকা পড়ে নি। ছবির পুরোভূমিতে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ঝোপঝাড়, পেছনে উঁচু গাছ। যত পেছনে দৃষ্টি যায় তত ঘন সবুজের সমারোহ। সবুজ কোথাও হালকা, কোথাও গাঢ়, কোথাও গভীর। এই চিত্রে প্রথম নদীজলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে হালকা নীল রং। আকাশ ঘন ধূসর। রং ব্যবহারে শিল্পীর চমৎকারিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। মাঠ, ঘাস, গাছ, নদী, ঘর ও আকাশ জুড়ে বিচিত্র রঙের সমাহার। চিত্রটির বিরচনগত দক্ষতাও প্রশংসনীয়।
ছাত্রজীবনেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের জলচিত্রগুলো উপস্থাপিত হয়। এবং বেশ কিছু চিত্র বিক্রিও হয়। কিন্তু ১৯৪২ সালে ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই তিনি জলরং মাধ্যমে চিত্রচর্চা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। কারণ ক্রমশ তিনি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমের অনুশীলনে।
সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।