জন্মশতবর্ষে সফিউদ্দীন আহমেদ
একজন চিত্রশিল্পীর জন্মশতবর্ষ উদযাপন দেশের পুরো চারুকলা জগতের জন্যই এক বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শুধু চারুকলা বা শিল্পকলা জগতের কথা বলছি কেন, দেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের জন্যই তা অশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষভাবে তিনি যদি হন দেশের পথিকৃৎ শিল্পীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য; তিনি যদি হন দেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক; তিনি যদি হন একজন সাধক শিল্পী; তিনি যদি হন সকলের কাছে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব; তিনি যদি হন সকলের কাছে শিল্পগুরুর মর্যাদায় আসীন। আমরা বলছি শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের (১৯২২-২০১২) কথা। এবছর পূর্ণ হয়েছে তাঁর শতবর্ষ। নব্বই বছর তিনি বেঁচেছিলেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর জীবনের শেষ চার বছরের অসুস্থতার কথা বাদ দিলে বাকি সময়টা তাঁর কেটেছে একান্ত ও একনিষ্ঠ শিল্পসাধনায়। দীর্ঘ সত্তর বছরেরও অধিক সময়ের সাধনার ফল হিসেবে যে চিত্রমালা আমরা তাঁর কাছ থেকে পাই তা সমগ্র জাতিরই এক শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পদ। যে সম্পদ রক্ষিত আছে সফিউদ্দীন শিল্পালয়ে। তাঁর সৃষ্টির প্রতিনিধিত্বমূলক সম্ভার নিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এই শিল্পালয়েই আয়োজিত হচ্ছে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। দর্শকরা তাঁর সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি দেখতে পাবেন সফিউদ্দীন জাদুঘরে রক্ষিত তাঁর জীবন-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ। এর মধ্যে আছে ১৯৫৪-৫৫ সালে ঢাকার বন্যা নিয়ে তাঁর ফটোগ্রফি-শিল্প।
পথিকৃৎ শিল্পীদের মধ্যে তো বটেই, বলা যায় সমগ্র চারুকলা অঙ্গনেই, তিনিই একমাত্র শিল্পী যিনি সবচেয়ে বেশি মাধ্যমে সার্থকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। ছাপচিত্রের মধ্যে এচিং, একুয়াটিন্ট, উড এনগ্রেভিং ও কপার এনগ্রেভিং ছাড়াও তেলচিত্র ও রেখাচিত্রে তাঁর উৎকর্ষ অসামান্য। জলরং, ড্রাই পয়েন্ট, ম্যুরাল পেইন্টিং ও লিথোগ্রাফি মাধ্যমেও তিনি চিত্র রচনা করেছেন; কিন্তু এ চার মাধ্যমের অনুশীলন শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখেননি। কিন্তু যেসব মাধ্যমের অনুশীলন তিনি অব্যাহত রেখেছেন সেগুলোর চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধনে তিনি ছিলেন বিপুল শ্রমনিষ্ঠায় আত্মনিমগ্ন। মাধ্যমগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁর এই সাধকসুলভ নিষ্ঠাবান নিমগ্নতাই তাঁর সৃষ্টিকর্মকে সার্থক করে তুলেছে। কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে তিনি শিক্ষকতার যে আদর্শ দেখেছেন সেটাই তাঁর এরূপ দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনোগঠনে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু তার আগেই পারিবারিক শিক্ষা ছিল তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক পাথেয়। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ নাগরিক পরিমণ্ডলে। তাঁর স্থায়ী আবাস ছিল কলকাতার অভিজাত অঞ্চলে। পরিবার-বলয়ে তিনি পেয়েছিলেন উন্নত সাংস্কৃতিক পরিবেশ। পারিবারিক পরিমণ্ডলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো তাই না, পরিবারের সদস্যরা নিজেরাও কোনো-না-কোনো সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মধ্যে ছিলেন ব্যাপৃত । এমনতরো পরিবেশের প্রভাবেই তাঁর সত্তা হয়েছিল পরিমার্জিত ও পরিশুদ্ধ; তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল নাগরিক বৈদগ্ধ্য, সততা স্নিগ্ধ উন্নত অভিরুচি ও পরিচ্ছন্নতার বোধ।
কোথায় তাঁর সবলতা আর কোথায় দুর্বলতা সে-বিষয়ে তিনি ছিলেন সচেতন। নিজের ভূমিকা বা অবস্থান সম্পর্কে এতটুকু বাড়িয়ে বলার কোনো প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিল না। অসাধারণভাবে তিনি ছিলেন বিনয়ী। কী বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন!- অথচ এ নিয়ে দেখিনি সামান্যতম অহংবোধ। সর্বদাই প্রচারবিমুখ তিনি; এবং নিভৃতপরায়ণতাই ছিল তাঁর স্বভাবের আসল বৈশিষ্ট্য। কখনো ছোটেননি অর্থ কিংবা খ্যাতির পেছনে। শিল্পচর্চাকেই সার্বক্ষণিক ধ্যানের বস্তু করে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্মের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে গভীর চিন্তা , পরিকল্পনা, আবেগ, মমতা, ভালোবাসা আর উৎকর্স সাধনের দৃঢ় অভিপ্রায়।
এসব দেখে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কথাই আমার মনে পড়ে। তৃণাঙ্কুর নামক দিনলিপি-গ্রন্থে বিভূতিভূষণ লিখেছেন, “জীবনের সার্থকতা অর্থ উপার্জনে নয়, খ্যাতি প্রতিপত্তিতে নয়, লোকের মুখের সাধুবাদে নয়, ভোগে নয়” – সে সার্থকতা শুধু আছে জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার ভেতরে, বিশ্বের রহস্যকে উপলব্ধি করার আনন্দের মধ্যে।” সফিউদ্দীন আহমেদও একইভাবে জীবনের সার্থকতা অর্থ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, জনপ্রিয়তা কিংবা ভোগের মধ্যে খোঁজেননি, খুঁজেছেন শিল্পকে, শিল্পের রহস্যকে গভীর থেকে গভীরতরভাবে উপলব্ধি করার ভেতরে।
এ কারণেই প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার নিরন্তর প্রয়াসই হয়ে উঠেছিল তাঁর শিল্পযাত্রার মূলকথা। রুচিশীল, সংগীতানুরাগী, সাহিত্যপিপাসু, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তদৃষ্টির অধিকারী এই শিল্পী মনে কখনো লালন করেননি কোনো আভিজাত্যের গৌরব। বরং তিনি ছিলেন এক প্রখর নীতিবোধের অধিকারী, সততার পূজারী, যা তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হয়েছিল।
সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পীসত্তার গভীরে লালিত ছিল এক সূক্ষ্ম অতৃপ্তির বোধ। এই অতৃপ্তি একজন মহৎ শিল্পীরই সহজাত বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই ছবি এঁকে তাঁর কখনো মনে হয়নি যে, তিনি ভালো কিছু এঁকে ফেলেছেন। এরকম অপূর্ণতা নিয়েই সবসময় কাজ করার ফলে কোনো এক বৃত্তে তাঁকেন আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়নি। পরিণামে রেখাচিত্র, ছাপচিত্র ও তেলচিত্র এই তিন মাধ্যমেই তিনি অর্জন করেছেন এক শিখরস্পর্শী কৃতিত্ব। ব্যক্তিজীবনের মহৎ ভাবনা নিঃসন্দেহে তাঁর শিল্পবোধকে সর্বদা সজীব ও সমৃদ্ধ করেছে। বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে তিনি সবসময়ই চেয়েছেন আত্মিক উন্নতিসহ শিল্পের উন্নতি ঘটাতে। সেজন্য সবসময় যুগের পরিবর্তনের ধারাকে নিজ চিত্রে অঙ্গীকার করারও চেষ্টা করেছেন। সবসময়ই চেষ্টা করেছেন চিত্রের জমিনে নতুন কিছু যোগ করার। মূলত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই আয়ত্ত করতে চেয়েছেন যুগের পরিবর্তনশীলতার দাবি। স্বল্পভাষী, কোমল স্বভাবের অধিকারী এই শিল্পীর মনে সর্বদাই ছিল এক গভীর প্রশান্তির ভাব, যা তাঁর চিত্রের জমিনকেও দিয়েছে অসামান্য প্রশান্তির ব্যঞ্জনা।
কলকাতা আর্ট স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী বহির্দৃশ্য অনুশীলনসূত্রে তিনি সতীর্থদের সঙ্গে চলে যেতেন কলকাতা শহর কিংবা শহরতলিসহ আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে। চিত্রে প্রকৃতির রূপ-রসকে পরিস্ফুটিত করার আগ্রহে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে প্রতি বছরই পূজার ছুটিতে কলকাতার বাইরে বেড়িয়ে পড়তেন। এভাবে গিয়েছেন বিহারের মধুপুর, দেওঘর, জেসিডি, গিরিডি, চাইবাসা, ঝাঝা প্রভৃতি অঞ্চলে। দুমকার নিসর্গ ও জীবন অবলম্বনে তাঁর মতো এত চিত্র অখণ্ড- বাংলার শিল্পীদের মধ্যে আর কেউ আঁকেননি। প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর নিবিড় বোধও গড়ে ওঠে দুমকায়।
মুকুল দে, রমেন চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পীরা ভারতের ছাপচিত্রকে বিশ শতকের ত্রিশের দশকে যে উন্নত শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন সফিউদ্দীন আহমেদকে তা আকৃষ্ট করে। তিনিও গভীর নিষ্ঠা নিয়ে শিক্ষকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছাপচিত্রকে পৌঁছে দেন শিল্পের উন্নত মহিমায়। ফলে সমগ্র ভারতের আধুনিক ছাপচিত্রের অগ্রণী শিল্পীদের তালিকায় তাঁর নামও অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
দুমকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার শালবন, ময়ূরাক্ষী নদী, আদিবাসী সাঁওতাল রমণীর দেহবল্লরীসহ তাদের সামগ্রিক জীবনকোলাহল তাঁর শিল্পবোধকে যেমন জাগ্রত করে তেমনি তাঁর চিত্রের জমিনকেও করে তোলে চিত্রগুণে সমৃদ্ধ। ১৯৪৫-৪৭ পর্বে চার-চারটি পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ এই পঁচিশ বছর বয়সী সফিউদ্দীন আহমেদ সর্বভারতীয় পর্যায়ে সম্ভাবনাময় একজন শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
দেশভাগ তাঁর জীবনে নিয়ে আসে এক গভীর পরিবর্তন। জন্মভূমি কলকাতার স্থায়ী আবাস থেকে উন্মূলিত হয়ে তাঁকে নতুন বসতি নির্মাণ করতে হয় ঢাকায়। এ ঘটনা তাঁর কাজের ধারায় নিয়ে আসে পরিবর্তন। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে পরপর দুবছর বন্যায় ঢাকাসহ সারা দেশ প্লাবিত হলে তিনি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।। কলকাতায় অবস্থানকালে এমন বন্যার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। প্রতিমুহূর্তে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই স্বচ্ছ পানির মধ্যে দেখেছেন মাছের খেলা। বন্যার পানির ওপরে দেখছেন বৃষ্টি পতনের এক ছন্দোময় রূপ আর ধ্বনিমাধুর্য। ফলে তাঁর পরবর্তী চিত্রধারায় অনিবার্যভাবেই বিষয় হিসেবে অন্বিত হয়েছে বন্যা, মাছ, জাল, নৌকা ও পানির বৈচিত্র্য। এছাড়া দুই বাংলার প্রাকৃতিক স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। ওখানকার প্রকৃতিতে ছিল ধূসরতা, এখানে এসে দেখেন নীলাভ সবুজের ছড়াছড়ি। দীর্ঘদিনের অভিনিবেশের ফলে নীল ও সবুজকে মিশিয়ে আকাঙ্ক্ষিত এফেক্ট তিনি আনতে সমর্থ হন তাঁর চিত্রে।
১৯৫৬ সালে সফিউদ্দীন আহমেদ লন্ডনে গিয়ে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে ডিস্টিংশনসহ উচ্চশিক্ষা লাভ ছাড়াও পরিদর্শন করেন ইওরোপের বিভিন্ন দেশের উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ নানা জাদুঘর। লন্ডনের স্কুলে তাঁর শিক্ষক মেলুয়িন ইভানস ছিলেন আধুনিক ছাপচিত্রের জনক স্ট্যানলি হেটারের বন্ধু। লন্ডনের শিক্ষা, শিক্ষকদের প্রশংসা এবং ইওরোপের বিভিন্ন মিউজিয়াম ও গ্যালারি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তাঁর মনে সৃষ্টি করে যে আত্মবিশ্বাস তা তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিধারাকে বেগবান ও সমৃদ্ধ করে। টেকনিকে সুক্ষ কারুকাজের বাইরে তাঁর চিত্রে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে : অবয়বের প্রস্থান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার স্বামীবাগে নিজ বাড়িতে একপ্রকার অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত জীবনযাপনের মধ্যে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী-সৃষ্ট মৃত্যুপুরীর বীভৎস রূপ। এই চোখই তাঁর পরবর্তীকালের চিত্রে মোটিফ হিসেবে অন্বিষ্ট হয়ে রূপক-প্রতীকের সুগভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।
জীবনের শুরু থেকেই সফিউদ্দীন আহমেদ চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে সততা বা আন্তরিকতার কোনো অভাব ঘটতে দেননি। ছবি আঁকার সঙ্গে আবিষ্কার করেছেন নিজ মনের বিপুল আনন্দের এক সুগভীর সম্পর্ক। নিসর্গ অনুশীলনের সূত্রেই তিনি অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির বিশালত্বকে; তাঁর চিত্রে এসেছে বিরচন-কৌশলের দক্ষতা; এসেছে উন্নত পরিপ্রেক্ষিতের বোধ। দুমকায় গিয়ে তিনি যথার্থভাবে অনুধাবন করেছেন প্রকৃতির আত্মাকে। ফলে চিত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির বিশাল পরিপ্রেক্ষিতকে। ক্ষুদ্র আয়তনে বিশালত্বের ব্যঞ্জনা সৃষ্টির বিষয়টি পরিণত হয়েছে তাঁর চিত্রধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্যে।
ছাত্রাবস্থা থেকেই কালো রঙের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা সৃষ্টি হয় সফিউদ্দীন আহমেদের মনে। কালো তাঁর কাছে বিবেচিত হয় রঙের রাজা হিসেবে। ফলে কালো রঙের অনুশীলনের জন্য ছাত্রজীবনেই বহুবার রাতের বেলা গেছেন কলকাতার শিয়ালদা রেলস্টশনে। উড এনগ্রেভিং মাধ্যমে চিত্র রচনার সময়ে তিনি এই রঙের সমৃদ্ধি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। লন্ডনেও তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে কালো রং আয়ত্ত করার কৌশল শেখার চেষ্টা করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে এসে তিন বছর যাবৎ তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাপৃত হন একগুচ্ছ রেখাচিত্র রচনায়, যেসব চিত্রে কালো রঙের বিচিত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি পরিতৃপ্তি লাভ করেন। এসব চিত্রে কালো রং ব্যবহারে তাঁর একপ্রকার সিদ্ধিকে আমরা দেখতে পাই।
তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মে শৈলীগত ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেও তা টেকনিকসর্বস্ব নয়, বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও সৃজনশীলতায় তা সমান সমৃদ্ধ। তাঁর সব ছবির ভেতরেই স্পষ্ট হোক কিংবা অস্পষ্ট হোক বিষয়বস্তুর উপস্থিতি লক্ষযোগ্য। তাঁর চিত্র-পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে এই বিষয়গত উপাদানের বৈভব। বিষয়-আহরণে তিনি দেশের আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। কলকাতা-পর্বে যেমন অন্বিষ্ট হয়েছে সেই মহানগরীর বস্তিজীবনের পারাবত, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন, তেমনি ঢাকা-পর্বে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি তাঁর চিত্রের উপজীব্য হয়েছে নানা শ্রমজীবী মানুষ : ঢাকা মহানগরীর শরবতবিক্রেতা, বাদামবিক্রেতা, ফলবিক্রেতা, কাপড়বিক্রেতা, ছাদ-পেটানো মজুরসহ বংলাদেশের কৃষক, জেলে, মাঝি, ছুতার, কুমোর, তেলি প্রমুখ । এদেশের সংগ্রামশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারা হিসেবে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
চিত্রে তিনি সবসময়ই দেশের স্বরূপসহ সমগ্র জাতির যন্ত্রণাকে তার আবেগসহ তুলে ধরতে চেয়েছেন। তবে এই দেশাত্মবোধ তাঁকে স্লোগানমুখরিত করে না, জীবনের গভীর মর্মমূলে তা আবেদন সৃষ্টি করে। কারণ, বিষয়বৈভবের সঙ্গে সবসময়ই সমৃদ্ধ শৈলীর একটা অসামান্য সমন্বয় ঘটাতে তিনি চেষ্টা করেছেন। প্রাচ্যের বিষয় ও পাশ্চাত্যের করণকৌশল – এ দুয়ের সার্থক সমন্বয় সাধনের প্রয়াসই তাঁর শিল্পচর্চার মূলকথা। জন্মশতবর্ষে এই সাধক-শিল্পীর প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমরা দৃঢ়ভাবেই মনে করি, তাঁর জীবনাদর্শ ও সৃষ্টিগুণকে অনুসরণ করা হলেই তাঁর প্রতি যথাযথভাবে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে।
সৈয়দ আজিজুল হক, চারু ও কারু কলা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।